তারল্য সংকটে বিমা দাবি পরিশোধ করতে পারছে না ফারইস্ট ইসলামী লাইফ

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বিমা, লালমনিরহাট, আদিতমারী,

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের শালমারা গ্রামের ফিরোজা বেগম প্রায় ১৫ বছর আগে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে ১২ বছর মেয়াদি পলিসি খোলেন।

প্রায় ৩ বছর আগে পলিসি তার পিলিসি পরিপক্ক হয়। এরপর থেকে ফিরোজা বেগম আমানতের ৮০ হাজার টাকা ফেরত পেতে নিয়মিত কোম্পানির স্থানীয় অফিসে যান। কিন্তু, তিনি কোনো টাকা ফেরত পাননি।

৫২ বছর বয়সী ফিরোজা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি আমার টাকা পাচ্ছি না।'

ফারইস্ট ইসলামী লাইফের এক কর্মকর্তা জানান, ফিরোজার মতো ফারইস্ট ইসলামীর প্রায় ৩ হাজার বিমাকারী তারল্য সংকটে প্রায় ১৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকার দাবি ফেরত পাচ্ছেন না।

ফিরোজা আরও বলেন, 'আমি তাদের অফিসে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার উত্তর সাপতানা গ্রামের দিনমজুর রফিকুল ইসলাম জানান, ৩ বছর আগে তার জীবন বীমা পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও তিনি এখনো টাকা ফেরত পাননি।

তিনি বলেন, 'আমার ৪০ হাজার টাকা পেতে প্রায়ই কোম্পানির অফিসে যাই। আমার স্ত্রী অসুস্থ, কিন্তু চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারছি না, এই মুহূর্তে টাকা খুবই প্রয়োজন।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফারইস্ট ইসলামী লাইফের লালমনিরহাট শাখার এক কর্মকর্তা জানান, জেলায় তাদের ২১ হাজার পলিসিহোল্ডার আছেন। এই পিলিসিহোল্ডারদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে এবং তাদের অনেকে আমানত ফিরে পেতে প্রতিদিন কোম্পানির স্থানীয় অফিসে ভিড় জমাচ্ছেন।

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'তবে প্রধান কার্যালয় টাকা ফেরত দিচ্ছে না।'

ফারইস্ট ইসলামী লাইফের লালমনিরহাট শাখার প্রধান আব্দুল হাই বলেন, 'কোম্পানির তারল্য সংকটের কারণে পলিসিহোল্ডাররা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। তাদের বিমা দাবি কবে নিষ্পত্তি হবে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তাদের ক্রমবর্ধমান চাপ এড়াতে নিয়মিত অফিসে করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।'

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফারইস্ট ইসলামীর চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসাইন বলেন, 'প্রতিষ্ঠানটির মালিকরা কারাগারে আছেন, এ অবস্থায় কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে।'

ফারইস্ট ইসলামীকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে সরকার নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করলেও তারা এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি করতে পারেননি বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হোসেন বলেন, 'এসব কারণে প্রয়োজনীয় হারে অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আরেকটি কারণ হলো নতুন বিমাকারীরা পলিসি খুলছে না, কারণ প্রতিষ্ঠানটি এখন দুর্নামগ্রস্ত। তাই, বিমাকারীদের অর্থ পরিশোধের তহবিলের ঘাটতে আছে।'

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (ইড্রা) মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফারইস্ট ইসলামীকে বকেয়া দাবি পরিশোধে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া তাদের কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে।

ইড্রার ২০২২ সালের অনিরীক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, ফারইস্ট ইসলামীর কাছে বর্তমানে ৪ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা পাওনা আছে। এর মধ্যে কোম্পানিটি নিষ্পত্তি করেছে মাত্র ৯৭০ কোটি টাকা বা মোট দাবির ২১ দশমিক ২৯ শতাংশ।

২০২১ সালের এপ্রিলে ফারইস্ট ইসলামীকে নিয়ে একটি বিশেষ অডিট পরিচালনায় দেশের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্ম শিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানিকে নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। ২০২২ সালের মে মাসে আইডিআরএ'র কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেন অডিটর।

অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়, কোম্পানিটির ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪৩২ কোটি টাকার হিসাব সংক্রান্ত অনিয়ম ধরা পড়েছে।

ফারইস্ট ইসলামীর সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও এমএ খালেক, সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহ, সাবেক পরিচালক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত।

মূলত ২টি উপায়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছিল। একটি হলো- বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে জমি কেনা এবং কোম্পানির মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিপ্ট (এমটিডিআর) বন্ধক রেখে ব্যাংক ঋণ নেওয়া।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়। একই মাসে তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহকে বরখাস্ত করে আইডিআরএ।

বর্তমানে ফারইস্ট ইসলামী স্বতন্ত্র পরিচালকদের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও বিমা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাঈন উদ্দীন বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি সঠিকভাবে ভূমিকা পালন করত এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করত- তাহলে গ্রাহকরা ভোগান্তিতে পড়তেন না। বিমা খাতের প্রতি জনগণের আস্থা ধরে রাখতে সরকার কোম্পানির পলিসিহোল্ডারদের দাবি নিষ্পত্তিতে একটি জরুরি তহবিল গঠন করতে পারে। তা না হলে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে।

Comments

The Daily Star  | English
Binimoy platform suspended by Bangladesh Bank

BB suspends Binimoy over irregularities

During the previous AL govt, it was developed by the IDEA under the ICT Division at a cost of Tk 65 crore.

11h ago