ডেঙ্গু কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে?

ফগার মেশিন দিয়ে মশা মাররা ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। ছবি: এমরান হোসেন

ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবার ভয়াবহ হতে পারে বলে বছরের শুরুতেই সতর্ক করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এরপরেও যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় বর্তমানে সারা দেশেই ডেঙ্গু রোগী ব্যাপক সংখ্যায় বাড়ছে বলে জানান তারা।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার ২ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ নিয়েও প্রশ্ন আছে। একদিকে ঢাকা উত্তর সিটি ড্রোন দিয়ে এডিস মশার লার্ভা খুঁজছে। অপরদিকে দক্ষিণ সিটি বলেছে, মশার লার্ভা পেলে তাদের খবর দিতে। ১৫ মিনিটের মধ্যে তাদের দল সেখানে পৌঁছে যাবে।

এই অবস্থায় দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

ঈদুল আজহার পর দেশে ডেঙ্গু রোগী ও এ রোগে মৃত্যু বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। সরকারি হিসাবে আজ শনিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১২ হাজার ১১৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৬৭ জন। তবে প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, কোরবানি ঈদের আগে ৭ দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৫৫৯ জন এবং মারা গেছেন ৮ জন। ঈদের পরের ৭ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ১৩৮ জন এবং একই সময়ে মারা গেছেন ১৭ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হন না এবং আউটডোরে চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। কেউ কেউ আবার পরীক্ষাও করান না। কাজেই আমরা যে তথ্য পাই, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে ডেঙ্গু রোগী কয়েকগুণ বেশি হবে।

ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা যে সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি, কয়েকটি জেলার সিভিল সার্জন অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও তা জানা গেছে।

তাদের ভাষ্য, বেসরকারি হাসপাতালগুলো অনেক সময় তথ্য দেয় না। আবার কেউ কেউ বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। তাদেরকে হিসাবে ধরা হয় না।

কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের পর থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করেছে এবং দিনকে দিন পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে।

কক্সবাজারে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৩৯ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৯১ জন বাংলাদেশি এবং ১ হাজার ৫৪৮ জন রোহিঙ্গা। একই সময়ে ২ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে।

কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. শাহ ফাহিম আহমাদ ফয়সাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদের পর থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। আমরা বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত রিপোর্ট পাই না। সেসব তথ্য এলে সংখ্যাটি কিছুটা হয়তো বাড়ত।'

'গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বছরের শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাই পরিস্থিতি কিছুটা হলেও ভালো আছে,' যোগ করেন তিনি।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে চট্টগ্রামে রোগী বাড়তে শুরু করেছে। চলতি বছরে জেলায় প্রায় ৭০০ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে জুলাইয়ের এই কয়েকদিনেই প্রায় ২৫০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।'

পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. এসএম কবির হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদের পর জেলার পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন ঈদ করতে বাড়ি আসায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের ডেঙ্গু বিষয়ে ধারণা নেই। তাই তাদের বোঝাতে একটু কষ্ট হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে আমাদের টেকনিক্যাল সাপোর্টের কিছুটা সংকট রয়েছে। আমরা সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আমাদের এখানে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ১২৬ জনের মতো রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।'

গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. খায়রুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলায় এ পর্যন্ত ৮৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আমাদের এখানে যে ট্রান্সমিশন তা স্থানীয়ভাবেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ কয়েকবছর ধরেই এখানে রোগী আছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় গাজীপুরে রোগী একটু কম। কারণ গত ২-৩ বছর ধরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অনেক কাজ করা হয়েছে।'

কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডেঙ্গুর আমরা যে হিসাব পাই সেটি প্রকৃত সংখ্যা না। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে দ্য ল্যানসেট জার্নালে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, সরকারি হিসাবের তুলনায় দেশে প্রায় ২০ গুণের মতো বেশি রোগীর তথ্য ছিল। অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন না। আবার অনেকই পরীক্ষাও করান না। কেবল যারা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, তাদের সংখ্যাই হিসাব করা হয়। সব তথ্য আমলে নিলে ডেঙ্গু রোগী সরকারি হিসাবের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি হতো।'

জ্বর হলেই সবাইকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, 'এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। প্রকৃতি রক্ষা না করলে আর জনগণ সচেতন না হলে সিটি করপোরেশনের পক্ষে রোগটি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।' 

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর ডেঙ্গু বাড়বে এটা আমরা মার্চেই বলেছিলাম। জেলা শহরগুলোতে রোগী এ বছর বেশি। এবার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে। আমরা কিন্তু একদিনে এই অবস্থায় আসিনি। সারা বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথাযথ উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হতো না। দেশে ডেঙ্গু স্থায়ী হতে যাচ্ছে।'

এই অধ্যাপকের ভাষ্য, 'গত বছর থেকেই কিছু জেলায় রোগী ছিল। এ বছর সেসব জেলায় আরও বেড়েছে। স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। তা ছাড়া ঈদের সময় অনেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে বাড়ি গেছে। ফলে ডেঙ্গুর বিস্তার আরও বেড়েছে। জেলা হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।'

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের (সিডিসি) পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর মশা বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ভেক্টরও বেড়েছে। তাই রোগীও বেড়েছে। সারা দেশে আগে থেকেই রোগী ছিল। তবে এ বছর কিছুটা বেশি।'

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিটি করপোরেশন একা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, যদি না জনগণ সচেতন হয়। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি। কেউ লার্ভার তথ্য দিলে আমাদের টিম তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাচ্ছে।'

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শফিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বছরের শুরু থেকেই আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। তবে জনগণ সচেতন হচ্ছে না বলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Nahid warns against media intimidation, vows stern action

The government will take stern action against those trying to incite violence or exert undue pressure on the media or newspapers, said Information Adviser Nahid Islam today

12m ago