রোয়াংছড়ি

শিক্ষকদের বকেয়া বেতন পরিশোধে সোয়া ১ কোটি টাকা ঘুষ আদায়ের অভিযোগ

রোয়াংছড়ি
রোয়াংছড়ি উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় ও (ইনসেটে) অভিযুক্ত উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ কামাল। ছবি: সংগৃহীত

বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় ইউএনডিপি পরিচালিত ১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ওই বিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত ৫৫ শিক্ষককেও সরকারিকরণের আওতায় আনা হয়েছে।

এর মধ্যে শিক্ষকদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের বিনিময়ে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ কামাল হোসেন ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ অভিযোগ তুলে সম্প্রতি ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ৪৩ শিক্ষক।  

গত বুধবার দাখিল করা এ অভিযোগপত্রে বলা হয়, সহকারী শিক্ষা অফিসার মুহাম্মদ কামাল হোসেন এবং অফিস কর্মচারীরা বেশ কয়েক বছর ধরে সহকারী শিক্ষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন উপায়ে অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। 

উপজেলায় সদ্য জাতীয়করণ করা ইউএনডিপির স্কুলের ৫৫ জন শিক্ষকের প্রাপ্য বকেয়া বেতন-ভাতা বাবদ বিলের বিপরীতে ওই কর্মকর্তা জনপ্রতি ৩ লাখ টাকা দাবি করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

শিক্ষকরা ওই টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেন ও পর ৪৩ জন শিক্ষকের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা করে মোট ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা আদায় করেছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগকারীদের একজন কুলামাছাং পাড়া স্কুলের সহকারী শিক্ষক উথোয়াইনু মারমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ৩ জুন উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা কামাল স্যার আমাকে কল করে অফিসে যেতে বলেন। যাওয়ার পর কামাল স্যার আমাকে বলেন, আপনার নামে বকেয়া বেতন ১৪ লাখ ২৪০ টাকা এসেছে। টাকাগুলো পেতে চাইলে আমাকে ৩ লাখ টাকা দিতে হবে। এটা কেউ যেন জানতে না পারে। কেউ জানলে আপনার চাকরি নিয়ে ঝামেলা হতে পারে।'

পুনর্বাসন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মেবু মারমা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ৫ মে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বাবলু মারমা স্যারের মাধ্যমে কামাল স্যার আমাকে ডাকেন। উপজেলা শিক্ষা অফিসে যাওয়ার পর তিনি আমার কাছে ৩ লাখ টাকা দাবি করেন। পরে তাকে ৩ লাখ টাকার চেক দিতে বাধ্য হই।'

শিক্ষকদের অভিযোগ, উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন নিজে এবং অফিসের উচ্চমান অফিস সহকারী উখিংপ্রু মারমা ও মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর মো. ফারুকের মাধ্যমে ওই ঘুষের টাকা সংগ্রহ করতেন।

শিক্ষকরা আরও জানান, শিক্ষকদের বিভিন্ন অনলাইন তথ্য আপডেটের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মোহাম্মদ ফারুক জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে নিয়ে থাকেন। শিক্ষকদের নিজের প্রোফাইলের পাসওয়ার্ড তৈরি করার পর বা আপডেট করার পর তা শিক্ষককে না দিয়ে জিম্মি করে বারবার তার কাছে যেতে বাধ্য করেন তিনি।

অন্যদিকে শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক ঋণ, চাকরি স্থায়ীকরণ, শ্রান্তি ও চিত্ত-বিনোদন ভাতা বিল এবং সব জাতীয় দিবসসহ সরকারি বিভিন্ন উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি বাজেট থেকে দুই-তৃতীয়াংশ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। 

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে রোয়াংছড়ি উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ কামাল হোসেনকে গতকাল বুধবার ও আজ বৃহস্পতিবার একাধিকবার কল করার চেষ্টা করা হলেও, ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। বুধবার সরেজমিনে রোয়াংছড়ি উপজেলা শিক্ষা অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে রোয়াংছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম জাকারিয়া হায়দার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিক্ষকদের বকেয়া বেতনের টাকার বিষয়ে কামাল হোসেন কাজ করেছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে পাস করিয়েছেন। তিনি কী করেছেন আমি জানি না।'

'তবে কামাল সাহেব আমাকে বলছিলেন যে শিক্ষকদের বকেয়া বেতনের টাকা পাস করাতে বিভাগীয় বিভিন্ন অফিসে যেমন অর্থ মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরে এবং অ্যাকাউন্টস অফিসে টাকা দিতে হয়েছে। শুনেছি কামাল সাহেব শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, অস্বীকার করব না। তবে সব শিক্ষক কামাল সাহেবকে টাকা দেননি,' যোগ করেন তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহ আল মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অভিযোগকারীদের শুনানি গ্রহণ করা হয়েছে। ভুক্তভোগী শিক্ষকরা সব ডকুমেন্ট আনতে পারেননি। সব ডকুমেন্ট জমা দেওয়া সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

যোগাযোগ করা হলে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা কামাল হোসেন ও অফিস কর্মচারীদের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। চেয়ারম্যানের নির্দেশে জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তথ্য যাচাই করা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের আরও তথ্য-প্রমাণ আগামী ৭ দিনের মধ্যে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে শিক্ষকদের।'
অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, পাহাড়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং ইউএনডিপির পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সুবিধা সহায়তা ও মৌলিক শিক্ষাদান প্রকল্পের আওতায় ২০০৮ সালে ২১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। রাঙ্গামাটিতে ৮১, খাগড়াছড়িতে ৪৯ ও বান্দরবানে এ ধরনের ৮০টি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে রোয়াংছড়ি উপজেলায় স্থাপিত হয় ১৬টি বিদ্যালয়। 

প্রকল্পের আওতায় শিক্ষকদের বেতন-ভাতাসহ বিদ্যালয় পরিচালনা করা হয় ২০০৯ সাল থেকে ২০০১৪ সাল পর্যন্ত। এরপর প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে বেতন-ভাতা ছাড়াই চাকরি করে আসছিলেন ৮৪০ শিক্ষক।

২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ওই ২১০ বিদ্যালয় জাতীয়করণের আওতায় আনার ঘোষণা দেয় সরকার। এ ঘোষণার পর গত বছরের ৭ এপ্রিল ২১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭৩৮ জন শিক্ষককে জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Cyber protection ordinance: Draft fails to shake off ghosts of the past

The newly approved draft Cyber Protection Ordinance retains many of the clauses of its predecessors that drew flak from across the world for stifling freedom of expression.

6h ago