একজন নিবেদিত শিক্ষক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ছবি: সংগৃহীত

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমার শিক্ষক, কিন্তু প্রচলিত অর্থে তার ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য আমার কখনো হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন, আমি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রজীবনের শুরু, যদিও তার আগের বছর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দিনমান আড্ডায় সময় কাটাতে শুরু করি। স্যারের সঙ্গে আমার দেখা সেই সময়ই; কিন্তু আমি তার ছাত্র হই তারও অনেক আগে। 'বিচিত্রা'য় 'উপরকাঠামোর ভেতরেই' শিরোনামের লেখাগুলোই সম্ভবত আমাকে তার নিয়মিত পাঠক করে তুলেছিল। কিন্তু যে দু'টি বই আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল তা হলো 'নিরাশ্রয় গৃহী' এবং 'অনতিক্রান্ত বৃত্ত'। স্বীকার করা দরকার, এতো বছর পরও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে যে দুই ক্ষেত্রেই বইয়ের শিরোনাম আমাকে প্রথম আকর্ষণ করে।

'নিরাশ্রয় গৃহী' বইয়ে সঙ্কলিত লেখাগুলোর কিছু আলাদা আলাদা করে আমি পড়েছিলাম বলেই অনুমান করি, কিন্তু বইটি আমি পড়তে শুরু করি প্রকাশের অনেক পরে। বইটি হাতে নিয়ে নামটি নিয়ে আমি বেশ কয়েক দিন একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছিলাম। কেননা, আমার কাছে মনে হয়েছিল যে এটা এক ধরনের প্যারাডক্স কিন্তু তার ভেতরে আমাদের সমাজের একটা ছবি আমি দেখতে পাই; আমাদের সমাজের সেই প্যারাডক্স আমরা কীভাবে দেখব, ভাববো বা ভাঙবো, এসব প্রশ্ন আমাকে তাড়িত করে। বয়সের কারণেই হোক, কি জানার সীমাবদ্ধতার কারণেই হোক, আমি এ নিয়ে অনেকটা বিহ্বল হয়ে পড়ি। প্রায় এ রকম অনুভূতি হয়েছিল 'অনতিক্রান্ত বৃত্ত' পড়ার পরেও। 

আমি যখন এই বই হাতে নিই, তখন স্যারের নিয়মিত পাঠকদের কাছে তা পুরনো বলেই বিবেচিত। স্যারের লেখার মধ্যে আমি এক ধরনের দৃশ্যমান ভাষা আবিষ্কার করেছিলাম। আমার কাছে মনে হতো যে শুধু যুক্তির ধার, উদাহরণের ব্যবহার, উদ্ধৃতির পরিমিতি নয়, তার লেখার শক্তি যে তিনি শব্দ দিয়ে চিত্র তৈরি করেন। এটা ফিকশনে সহজলভ্য, কিন্তু বিষয়মুখ্য ভারি বিষয়ে সম্ভব, সেটা আমি স্যারের লেখাপড়ার আগে বুঝতে পারিনি। আমার এই ধারণা বদল হয়নি, বরঞ্চ সেটা আরও গভীর হয় 'কুমুর বন্ধন' বইটা পড়ার পর।

বিষয় এবং ভাষা দুই-ই নতুন; কোনো কিছুকে নতুনভাবে দেখার জন্য যে ভিন্ন জায়গায় দাঁড়াতে হয় সেটা আমার লেখালেখির জীবনের গোড়াতেই শিখতে শুরু করি তার লেখা পড়ে। আমার জন্য সেটা বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে সেই সময়ে আমার লেখালেখির বিষয় ছিল সমকালীন সাহিত্য। আসলে এভাবে বললেই ঠিক হবে যে সেই সময় আমি সাহিত্য বিষয়ে লেখার জন্য চেষ্টা করতে শুরু করেছি। স্যারের ভাষাভঙ্গি আমাকে এতটা প্রভাবিত করেছিল যে বন্ধুদের আড্ডায় আমি 'সিরাজ স্যারের ভাষায়' যেকোনো বিষয়ে কথা বলতে পারি বলেই বন্ধুরা বলতে শুরু করেছিল। আমার লেখায়ও তার ছাপ রয়েছে, ১৯৭৮-৭৯ সালে 'দৈনিক বাংলা'য় প্রকাশিত বেশ কিছু রচনা যেগুলো 'লেখকের দেশকাল' নামের বইয়ে একত্রিত, সেখানে এটা খুব স্পষ্ট। কিন্তু শুধু ভাষা নয়, স্যারের লেখালেখি থেকে আরেকটি বিষয় আমার মাথার ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং পরে পোকার মতো মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকে, তা হলো মধ্যবিত্তের অবস্থা ও অবস্থান। তার লেখা পড়ে আমার কাছে মনে হতো যে তিনি মধ্যবিত্তের শ্রেণিগত অবস্থান শুধু নয়, তার সাংস্কৃতিক ভূমিকার প্রশ্নটিকে সামনে আনার চেষ্টা করেছেন। 

কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে আমার কাছে এই বিষয়টি বেশ বড় একটা বিষয় হিসেবে কাজ করেছে। ভারতে মধ্যবিত্তের বিকাশের প্রশ্ন আমি প্রথম ভিন্নভাবে বিবেচনা শুরু করি মার্কসের 'উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে' বইয়ের কারণে; সেটা ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে। সে সময় রাজনীতির প্রচলিত ব্যাখ্যায় এক ধরনের 'অর্থনৈতিক নিয়তিবাদ' বা 'ইকোনমিক ডিটারমিনজম' ছিল বলেই আমার ধারণা; সেখানে সিরাজ স্যারের লেখায় একটা ব্যতিক্রমী অবস্থান দেখতে পাই।

তাছাড়া তাঁর লেখায় সংস্কৃতির প্রশ্নটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে জায়গা পেয়েছে বলেই আমার মনে হয়েছে; মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি। সেটা আমাকে নতুনভাবে ভাবতে এবং এই বিষয়ে ইংরেজি এবং বাংলা দুই বিষয়েই পড়তে অনুপ্রাণিত করেছে। সবসময় স্যারের সঙ্গে একমত হয়েছি, তা বললে অসত্য ভাষণ হবে; স্যারের লেখাই শুধু আমাকে ভাবিয়েছে তা-ও নয়; কিন্তু শুরুটা একার্থে স্যারের লেখা থেকেই। তারুণ্যের এই সময়টায় আমাকে ক্লাসরুমে না নিয়েও; এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় পৌঁছার আগেই তিনি আমার শিক্ষক হয়ে ওঠেন। আমি সেই থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ছাত্র। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর স্যারের কাছাকাছি আসার সুযোগ তৈরি হয় ১৯৭৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর। স্যার ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন; আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। অনেকের হয়তো জানা না-ও থাকতে পারে যে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ডাকসুর সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং এর কোষাধ্যক্ষ একজন শিক্ষক। ডাকসুর কারণে স্যারের কক্ষে প্রবেশাধিকার পাওয়া গেল কিন্তু সেই থেকে শুধু সেই কারণেই স্যারের কাছে গিয়েছি, তা নয়। গোড়াতে সেটাকে যে ছুতো হিসেবে ব্যবহার করতাম, সেটা এখন বলতে দ্বিধা নেই। কিন্তু সেই সূত্রে স্যারকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ তৈরি হয়। স্যার সস্নেহে আমাদের কাছে টেনেছেন, সেটা অংশত আমাদের তখনকার রাজনৈতিক অবস্থান, কিন্তু সেটা একমাত্র কারণ বলে আমার কখনই মনে হয়নি। সেই সূত্রে আমার অনেক স্মৃতি আছে স্যারকে বিরক্ত করার। কিন্তু তাকে আমি কখনই বিরক্ত হতে দেখিনি, তার ধৈর্য আমাকে সবসময়ই বিস্মিত করেছে।

দ্বিতীয় দফা ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৮২ সালে ডাকসুর একুশের সঙ্কলনের জন্য স্যারের লেখা আনার ঘটনা এখনও মনে আছে। ভাষা আন্দোলনের তিরিশ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নিলাম যে 'ফুল খেলবার দিন নয়' বলে সঙ্কলনে কয়েকজন মেধাবী ছাত্র ও শিক্ষকের কাছে একটা অভিন্ন প্রশ্ন রাখব এবং তাঁদের অনুরোধ করব যেন তারা যেন সংক্ষেপে লিখিতভাবে তার উত্তর দেন। কবিতা ও গল্পের আগে এক বা একাধিক প্রবন্ধের বদলে এই উত্তরগুলো ছাপা হবে। 

শিক্ষার্থীদের একটা তালিকা তৈরি করলাম। কলা ভবনের দোতলায় স্যারের অফিসকক্ষে গেলাম আমার এই পরিকল্পনা নিয়ে। স্যার জানতে চাইলেন, যে প্রশ্নটা করা হবে সেটা কী প্রশ্ন? হঠাৎ মনে হলো আমি যে প্রশ্নটা ভাবছি সেটা স্যারের পছন্দ নাও হতে পারে। দ্বিধান্বিতভাবে বললাম, প্রশ্নটা হলো 'একুশে ফেব্রুয়ারি কি ব্যর্থ হয়ে গেছে?' আমার মনে এই প্রশ্ন কেন এলো সেই বিষয়ে স্যারের সঙ্গে অনেক আলোচনা হলো; সেই আলোচনার কারণেই যাদের কাছে প্রশ্ন পাঠানো হলো তাদের কাছে একটা দীর্ঘ ভূমিকাও পাঠানো হয়েছিল। সেই ভূমিকা লেখার তাগিদটা স্যারের সঙ্গে আমার কথোপকথন। লেখক তালিকায় শিক্ষকদের মধ্যে সরদার ফজলুল করিম স্যার ছিলেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল সলিমউল্লাহ খান, সুব্রত ধর, সৈয়দ আখতার মাহমুদ, মনিরুল ইসলাম খান, তুষার দাশ (সঙ্কলনটা সংগ্রহে না থাকায় অন্যদের কথা মনে করতে পারছি না)। কিন্তু যেদিন স্যারের লেখা আনতে গেলাম, স্যার বললেন সব কথা তো বলা হলো না। পরে সম্ভবত এই শিরোনামে স্যার 'সংবাদে'র একুশের সংখ্যায় একটা লেখা লিখেছিলেন।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শুধু একটি নাম ছিল, তা নয়; আমার কাছে তো নয়ই, আমার কাছে তাকে মনে হতো আক্ষরিক অর্থেই একজন নিবেদিত শিক্ষক। তাঁর জীবনযাপনে বাহুল্য দেখিনি। সেটা আমাকে শিক্ষকতার জীবনের দিকে আকৃষ্ট করেছে। পারিবারিকভাবে আমার সবচেয়ে বড় ভাই আলী আনোয়ার অধ্যাপনা করেন; কিন্তু তিনি থাকতেন রাজশাহীতে। ফলে তাকে প্রতিদিন দেখার সুযোগ হয়নি। শিক্ষকতার জীবন বলতে যে আদর্শস্থানীয় মানুষ, সেটা ছাত্রজীবনে আমার কাছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

১৯৮৪ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই তখন তিনি আমাকে সহকর্মী হিসেবেই দেখেছেন। আমি তখনও তাঁর ছাত্রই আছি। শিক্ষক রাজনীতির কারণে তার সঙ্গে কাজ করেছি পরবর্তী তিন বছর। একমত হয়েছি, আমাদের মতভিন্নতাও হয়েছে; কিন্তু আমার কখনও মনে হয়নি আমি তাঁর স্নেহবঞ্চিত হয়েছি। ১৯৯৩ সালে, ছয় বছরের ব্যবধানে আবার যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ফিরি ততদিনে অনেক কিছু বদলেছে, আমার চিন্তায়ও বদল ঘটেছে; শিক্ষকদের রাজনীতি ও সংগঠনে আর যুক্ত না হওয়ার কারণে স্যারের সাহচর্যের সুযোগ মেলেনি। দুই বছর না পেরুতেই আমি আবার প্রবাসী হই। 

আমার প্রবাসজীবন ইতোমধ্যে দীর্ঘ হয়ে উঠেছে। নিয়মিত দেশে যাওয়া হলেও অনেক দিন স্যারের সঙ্গে দেখা হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় স্যারের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে, অর্থাৎ ১৯৭৭-৭৮ সালের আগে যেমন, এখনও তেমনি, আমি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ছাত্র আছি; দেখা না হলেইবা কী। ২৩ জুন আমার প্রিয় স্যারের ৮৮তম জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও অফুরন্ত ভালোবাসা। পাশাপাশি তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।

Comments

The Daily Star  | English

Major trade bodies miss election deadline as reforms take centre stage

Elections at major trade bodies have missed the 90-day deadline as new administrators of the business organisations seek amendments to the governing rules.

15h ago