বাংলাদেশে শিক্ষায় বরাদ্দ ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, দ. এশিয়ায় সবার নিচে

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শিক্ষাখাতে জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার পরামর্শ ইউনেস্কোর, যা প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে অনেক বেশি।

শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কম দেওয়ার কারণে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের বাজেট-পরবর্তী এক আলোচনায় উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জিডিপির শতাংশ হিসেবে বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে গড় ব্যয় ছিল ৪১টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে পঞ্চম সর্বনিম্ন।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই হ্রাসের প্রবণতায় ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের মধ্যে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির ৩ শতাংশে উন্নীত করার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অর্জন করা সম্ভব হবে না।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বাজেট সবচেয়ে কম।'

'স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর আরও অর্থনৈতিক দক্ষতা প্রয়োজন হবে। বর্তমানে শিক্ষার যে মান, সেই অনুযায়ী আমরা প্রয়োজনীয় দক্ষতা পাব না।'

২০০৯-১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট প্রথম বাজেট পেশ করার পর থেকে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার শিক্ষাখাতে জিডিপির সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে। এরপর থেকে গত ৭ বছরে এই বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমেছে এবং ক্ষমতাসীন সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এটি একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে।

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৮৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সব পর্যায়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

তিনি বলেন, 'আজকের শিশুরাই আমাদের উন্নত-সমৃদ্ধ-স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে। সুতরাং আমরা শিক্ষার্থীদের প্রধানত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও জলবায়ু পরিবর্তন থেকে উদ্ভূত আসন্ন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এবং এগিয়ে যেতে সক্ষম করতে চাই। আমাদের লক্ষ্য বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিভিত্তিক, দক্ষতা বৃদ্ধিকারী ও সৃজনশীলতা-সহায়ক শিক্ষা প্রদান করা, যা তাদের মধ্যে সেবা প্রদানের চেতনা জাগিয়ে তুলবে।'

তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, কীভাবে এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হবে, সে বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা পাননি তারা।

ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিক্ষা আন্দোলনকারীরা দীর্ঘদিন ধরে এই খাতে বাজেট বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু তাদের দাবির কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।'

'শিক্ষাখাতে বাজেট হতাশাজনক। বাজেট বক্তৃতা চমৎকারভাবে তৈরি করা হয়েছে, সবকিছু সেখানে রয়েছে। এতে স্মার্ট নাগরিক, মূল্যবোধসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি ও শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে এগুলো নিশ্চিত করা হবে, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনাই বক্তৃতায় অনুপস্থিত।'

সিপিডি '২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট বিশ্লেষণ' শীর্ষক উপস্থাপনায় বলেছে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩৫টি স্বল্পোন্নত দেশ গড়ে তাদের জিডিপির ২ শতাংশ বা তার বেশি শিক্ষাখাতে ব্যয় করেছে। একই সময়ে বাংলাদেশের গড় শিক্ষা ব্যয় ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮ শতাংশ। শুধু সোমালিয়া দশমিক ২ শতাংশ, হাইতি ১ দশমিক ৫ শতাংশ, দক্ষিণ সুদান ১ দশমিক ৫ শতাংশ ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ নিয়ে তালিকায় বাংলাদেশের পরে রয়েছে।

সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র আফ্রিকার দেশ, যা সংঘাতে বিপর্যস্ত। এসব দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ক্রমবর্ধমান সহিংসতার কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে, গ্যাংভিত্তিক সহিংসতা ক্যারিবিয়ান দেশ হাইতিকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে, যা ফলে দেশটিতে কলেরার পুনরুত্থান ও চরম মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ, কঙ্গো ও উগান্ডা ২ দশমিক ২ শতাংশ, চাদ ২ দশমিক ৫ শতাংশ, কম্বোডিয়া ২ দশমিক ৬ শতাংশ, রুয়ান্ডা ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, সেনেগাল ও ইথিওপিয়া ৫ দশমিক ১ শতাংশ এবং সিয়েরা লিওন ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যয় করে শিক্ষাখাতে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জিডিপির শতাংশ হিসেবে বাংলাদেশের গড় শিক্ষা ব্যয় আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে কম।

তাদের তথ্যে আরও দেখা যায়, ভুটান ২০২১ সালে জিডিপির ৭ শতাংশ, ভারত ২০২০ সালে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, পাকিস্তান ২০২১ সালে ২ দশমিক ৪ শতাংশ, মালদ্বীপ ২০২০ সালে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ, নেপাল ২০২০ সালে ৪ দশমিক ২ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ২০১৯ সালে ১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং আফগানিস্তান ২০১৯ সালে ২ দশমিক ৯ শতাংশ ব্যয় করেছে শিক্ষাখাতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসির পরিচালক অধ্যাপক আবু ইউসুফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কর্মসংস্থান সৃষ্টির সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক রয়েছে। এত সামান্য বরাদ্দ নিয়ে শিক্ষাখাতের পক্ষে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখা সম্ভব নয়।'

'বর্তমানে আমরা গ্রাজুয়েট তৈরি করছি, কিন্তু মানসম্পন্ন গ্রাজুয়েট তৈরি করছি না।'

তিনি আরও বলেন, 'চাকরিপ্রার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমরা কোনো উদ্যোগ দেখছি না। সামগ্রিকভাবে বাজেটে গবেষণাখাতকেও যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।'

রাশেদা কে চৌধুরী ও অধ্যাপক আবু ইউসুফ—দুজনেরই ভাষ্য, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা মোকাবিলায় অর্থমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ দেননি।

ফাহমিদা খাতুনের মতে, সরকার অবকাঠামোভিত্তিক উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে শিক্ষায় বরাদ্দ কম রেখেছে।

Comments

The Daily Star  | English
conflict over security responsibilities at Dhaka airport

Dhaka airport: APBn at odds with aviation force over security duties

A conflict has emerged between the Aviation Security Force (AVSEC) and the Airport Armed Police Battalion (APBn) over security responsibilities at Hazrat Shahjalal International Airport (HSIA). APBn claims that AVSEC took control of their office on October 28, hindering their ability to perform duties effectively

1h ago