গণরুম, গেস্টরুম ও র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছেলেটির একার লড়াই নয়
কয়েকদিন ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী প্রত্যয় ৩টি দাবিতে অনশন কর্মসূচী পালন করছেন। দাবিগুলো হলো, 'গণরুম' বিলুপ্তি, 'মেয়াদোত্তীর্ণ' শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে হলত্যাগ, এবং 'গণরুম' 'মিনি গণরুমে' অবস্থান করা বৈধ শিক্ষার্থীদের 'সিট' নিশ্চিত করা। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তার উত্থাপিত দাবিগুলো যৌক্তিক ও ন্যায্য। মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে জানতে পারলাম লোডশেডিং চলাকালীন রাত ১১টার দিকে কিছু ছাত্র প্রত্যয় যেখানে অনশন করছেন সেখানে আসেন। তারা ছেলেটিকে জোরপূর্বক অ্যাম্বুলেন্সে তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলে পাঠিয়ে দেয়। ছেলেটির সমর্থনে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপরেও হামলা চালানো হয়। হামলায় তাতে অন্তত দু'জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। হামলাকারীরা উপস্থিত নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি কটূক্তি করা, গায়ে হাত দেওয়াসহ নানা অবমাননাকর আচরণ করতে থাকেন। এর প্রতিবাদে আক্রান্ত ও ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মাঝরাতে উপাচার্যের বাসার সামনে জড়ো হয়ে ঘটনার প্রতিকার দাবি করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করেছেন। একটা ন্যায্য দাবিগুলো তুলে ধরার পরে বিষয়টির সুষ্ঠু প্রতিকার না হয়ে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটা নিতান্তই দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত।
এর আগে আমরা লক্ষ্য করেছি গত কয়েকদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনশনরত প্রত্যয়ের খোঁজখবর নিয়েছেন, তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, মীর মশারফ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ্যসহ প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তারা ওই শিক্ষার্থীকে আশ্বস্ত করেছেন যে, তার দাবি মেনে নেওয়া হবে। এতে আমি আশাবাদী হয়েছিলাম এই ভেবে যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হয়তো ন্যায্যতার প্রশ্নে সংক্ষুব্ধ ওই শিক্ষার্থীর প্রতি সহমর্মী হয়ে তার আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেছেন। আমি এ জন্য শিক্ষক সমিতির কাছে লেখা এক চিঠিতে প্রশাসনকে সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। একইসঙ্গে সমিতির কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলাম, উত্থাপিত ন্যায্য দাবিগুলো মেনে নেওয়ার প্রক্রিয়া দৃশ্যমান করবার মধ্য দিয়ে প্রশাসনকে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের ব্যাপারে শিক্ষক সমিতি যেন উদ্যোগী হয়। শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ ছেলেটির সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন।
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী কারোরই কোনো ধরণের মৌখিক আশ্বাসে আস্থা রাখতে চাইছেন না। বরং তিনি দাবি বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট অগ্রগতি দেখতে চেয়েছেন। যেমন বৈধ নন এমন সাবেক বা বহিরাগত যারা হলে অবস্থান করছেন তাদের তালিকা প্রণয়ন শুরু করা ইত্যাদি। কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি দৃশ্যমান না হওয়ায় এক পর্যায়ে তিনি স্যালাইন গ্রহণ থেকেও বিরত থাকেন। আবার হল প্রশাসন যখন তালিকা প্রস্তুত করার কাজটি শুরু করেন তখন তিনি আবার স্যালাইন নেওয়া শুরু করেন, কিন্তু অনশন অব্যাহত রাখেন। আপাতত দৃষ্টিতে প্রত্যয়ের এমন অবস্থান আমাদের কাছে আবেগতাড়িত কিংবা অযৌক্তিক মনে হতে পারে। এমনো মনে হতে পারে যে, উপাচার্যের আশ্বাসের পরে অন্তত তার অনশন ভেঙে ফেলা উচিত ছিল। এক্ষেত্রে স্মর্তব্য যে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পরে বছর সিট সংকট, গণরুম, গেস্টরুম ও র্যাগিংয়ের নামের অরাজকতা চলমান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রায় লাগাতারভাবেই ব্যর্থতার নজির সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর প্রশাসনের ভূমিকা কিংবা প্রতিশ্রুতিতে আস্থা না রাখতে পারারই কথা। উপরন্তু সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী নিজেও এই অরাজকতার শিকার হয়েছেন। তার ভাষায় একজন 'মেয়াদোত্তীর্ণ' শিক্ষার্থী তাকে বের করে দিয়ে রুমে তালা দিয়েছেন। তারপর তিনি এই অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে বসেছেন। এমন পরিস্থিতিতে ওই শিক্ষার্থীর আচরণগত ত্রুটি ধরতে চাওয়া এবং তিনি প্রশাসনের কর্তা শিক্ষকদের প্রতি যথোচিত আচরণ করলেন না- এমন অভিযোগ উত্থাপন এই মুহূর্তের বিবেচ্য হতে পারে না। বরং তার যৌক্তিক প্রতিবাদ কর্মসূচীকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
প্রত্যয়ের ক্ষোভ ও হতাশার নেপথ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার যে সামষ্টিক দায় রয়েছে সেটি স্বীকার করে নেওয়া উচিত। তিনি তো কোনো অপরাধী নন, বরং আমার বিবেচনায় এই নতজানু সমাজের যে দুএকজন ব্যতিক্রমী মানুষ প্রতিবাদের নজীর রাখেন, তিনি তেমন একজন। আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তখন তিনি চলমান অরাজকতার সঙ্গে জর্জ অরয়েলের '১৯৮৪' উপন্যাসের কাহিনীর তুলনা টেনে কথা বলছিলেন। যখন আমি তাকে র্যাগিং নামক ব্যবস্থা কীভাবে দলতন্ত্রের বাইরেও সাধারণ শিক্ষার্থীর সমর্থনে টিকে আছে সেই কথা বলছিলাম, তিনি মাথা নেড়ে আক্ষেপের স্বরে বলছিলেন 'স্টকহোম সিন্ড্রোম' এর কথা। তারা সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল আহা! বিশ্ববিদ্যালয়ে তো এমন মানুষদেরই বেড়ে উঠার কথা। ছেলেটির অনশনের ষষ্ঠ দিন অতিক্রান্ত হচ্ছে। তিনি কেবল ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন নিচ্ছেন। এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আমি এখনো বিশ্বাস করি, নিজেদের তৎপরতাকে কাগুজে কিংবা মৌখিক আশ্বাসে আটকে না রেখে, ওই শিক্ষার্থীর দাবিগুলো মেনে নেওয়ার ব্যাপারে যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দৃশ্যমান, কার্যকর এবং একইসঙ্গে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করে, প্রত্যয়ের দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে এবং তাকে উঠিয়ে দিতে চাওয়া ও তার সতীর্থদের ওপরে হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনে, তাহলে নিশ্চয়ই এই অচল অবস্থার অবসান ঘটবে। শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিশ্চয়ই এটুকু করতে সক্ষম হবে।
সাঈদ ফেরদৌস: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Comments