২০২২-২৩: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অর্থবছর

স্টার ফাইল ফটো

এক বছর আগেই ৫৫৩ টাকায় মোটামুটি পরিমাণ চাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, লবণ ও ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারতেন ঢাকায় বসবাসকারী বেসরকারি চাকরিজীবী আমিনুর রহমান।

৫ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী আমিনুর গতকাল একই পরিমাণ পণ্য কিনেছেন ৬৪৩ টাকায়, যা আগের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি।

শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়, ২০২২ সালের মে মাসের সঙ্গে যদি চলতি বছরের একই মাসের তুলনা করলে আরও অনেক খাতেই আমিনুরকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

ঢাকার মিরপুরে ২ রুমের যে বাসাটিতে ভাড়া থাকেন আমিনুর, তার ভাড়াও বৃদ্ধি করেছেন বাড়িওয়ালা। একইসঙ্গে বেড়েছে পরিবহন খরচও।

আমিনুর জানান, যদিও বছর শেষে তার বেতন বেড়েছে ৩ হাজার টাকা, কিন্তু গত এক বছরে তার সামগ্রিক মাসিক ব্যয় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টাকা বেড়েছে। যা তার বেতন বৃদ্ধির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। অতিরিক্ত এই ব্যয় বহন করতে তার পারিবারিক বিভিন্ন কেনাকাটায় কম খরচ করতে হচ্ছে।

চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে আমিনুরের মতো আরও অনেকেরই নাভিশ্বাস অবস্থা।

দ্রব্যমূল্য কমায় এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে এখনো তা উচ্চহারেই রয়েছে।

পণ্যমূল্য এপ্রিলে ১২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়েছিল ছিল, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশের চেয়ে বেশি।

সরকার এই অর্থবছরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা পরে সংশোধন করে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বর্তমান হার তার চেয়েও বেশি। ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সংকট আরও গভীর হয়েছে।

রাজধানীর কল্যাণপুরের বাসিন্দা মিনহাজ উদ্দীন জিতুর ৫ সদস্যের পরিবার। সেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী মিনহাজ বলেন, 'আমার বড় ছেলের বয়স এখন ১৮ মাস। আমার ছেলের বয়স যখন ১০ মাস, তখন আমার স্ত্রী একটি প্রাইভেট স্কুলে চাকরি শুরু করতে বাধ্য হয়। কারণ আমাদের খরচ বাড়তে থাকে এবং আমার আয় সেই খরচের জন্য যথেষ্ট ছিল না।'

বেতন না বৃদ্ধি পাওয়ায় আমিনুরের মতো পরিবারের খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন জিতুও।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় ভ্রমণ ও পোশাকের বাজেট কমিয়েছেন তিনি।

জ্বালানির দামবৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, পরিবহন ব্যয়, চিকিৎসা ব্যয় ও শিক্ষা ব্যয়ের কারণে মাসিক বেতন দিয়ে সব খরচ মেটাতে পারছেন না তারা।

গত এক বছরে ভোজ্যতেলের মতো বিভিন্ন আমদানিভিত্তিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। কিন্তু জিতু বা বাংলাদেশের কোনো ভোক্তা স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব দেখেননি।

কারণ মার্কিন ডলারের ঘাটতি এবং সরকারি সংস্থাগুলো পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য উচ্চতর আমদানি ব্যয়ের কারণে আমদানিকারকরা দাম কমায়নি।

তবে, এর পেছনের কারণ হিসেবে সরবরাহ শৃঙ্খলের অসঙ্গতিকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে বলেছে, বাংলাদেশে পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণেই নয়।

এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা।

গত এক বছরে বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সামান্য কমেছে। তবে দাম বেড়েছে এমন পণ্যের তালিকাই দীর্ঘ।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশের ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে শুধু চাল, ভোজ্যতেল ও মসুর ডালের দাম কমেছে। অন্যদিকে ঢাকায় পেঁয়াজ, আলু, ডিম ও চিনির মতো অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে।

বাজারে মাছ, মাংস ও সবজির দাম ওঠানামা করলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেশি ছিল। এ ছাড়া সাবান, টুথপেস্ট, প্রসাধনী, টিস্যুসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশ বেড়েছে।

রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকায় বসবাসকারী একটি বেসরকারি কোম্পানির চাকরিজীবী মোস্তফা কামাল বলেন, 'দামবৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য কেনা ৩০ শতাংশ কমাতে হয়েছে। এমনকি আমি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়াও করা বন্ধ করে দিয়েছি। এ নিয়ে পরিবারে অসন্তোষও আছে।'

খিলগাঁওয়ে বসবাসকারী একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মচারী আলতাফ হোসেন বলেন, 'বাজারে পণ্যের দামের পরিস্থিতিতে আমি বেশ চিন্তিত। কীভাবে মাসিক খরচ জোগাব, এই চিন্তায় রাতে ঘুমাতেও পারি না।"

একটি মোবাইল ফোন বিক্রি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী সোহান হোসেন জানান, তার মা ৪ বছরের বেশি সময় ধরে অস্টিওআর্থারাইটিস ভুগছেন।

'মায়ের চিকিৎসার খরচ কীভাবে চালাব, সারাক্ষণ তা নিয়ে চিন্তায় থাকি। যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে চিকিৎসার খরচ কীভাবে বহন করব?'

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, মুদ্রাস্ফীতির কারণে মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন খাতে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে।

'এটি ভবিষ্যতে তাদের জীবনে নেতিবাচক জটিলতা সৃষ্টি করবে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান আরও বলেন, 'জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির ফলে স্থায়ী আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান খারাপ হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যম ও স্থির আয়ের মানুষের দুর্দশা আরও বেড়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Domestic tourism heats up this winter

The local tourism industry was suffering from apprehension over the loss of business amid a long recession stemming from mass unrest, which began in July

2h ago