আমরা সরকারের পাতানো ফাঁদে পা দিচ্ছি না: মির্জা ফখরুল

আন্দোলন নিয়ে আমাদের কৌশল আছে। সেই কৌশলে আমরা স্থিরভাবে এগোচ্ছি।

'টাইমিংয়ের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলন নিয়ে আমাদের কৌশল আছে। সেই কৌশলে আমরা স্থিরভাবে এগোচ্ছি। আমরা অস্থির হচ্ছি না। আমরা সরকারের পাতানো ফাঁদে পা দিচ্ছি না।'

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চলমান আন্দোলন নিয়ে কথাগুলো বললেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

পাশাপাশি আগামী নির্বাচন ও বিদেশিদের কাছে 'ধর্ণার' বিষয়ে আওয়ামী লীগের অভিযোগ, বৈশ্বিক রাজনীতি এবং সার্বিকভাবে দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।

দ্য ডেইলি স্টার: সমালোচনা আছে যে বিএনপির আন্দোলনের ধারাবাহিকতা নেই। বিভাগীয় জনসমাবেশ করে যে জনসমর্থনের প্রমাণ দিয়েছিল বিএনপি, পরবর্তীতে সেই ধারাবাহিকতা আর রাখতে পারেনি। এই অভিযোগকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর: আমরা ধারাবাহিকভাবেই আন্দোলনে আছি। কখনোই আন্দোলনের বাইরে যাইনি। আমাদের আন্দোলনের ধরনটা হচ্ছে—একেক সময় একেক রকম। দেখুন ১০ ডিসেম্বরের পরপরই রমজান আমরা বিবেচনায় রেখেছি। তারপরেও মহানগর, জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কর্মসূচি দিয়েছি, সমাবেশ করেছি, পদযাত্রা করেছি, অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছি। ইউনিয়ন পর্যায়েও অবস্থান ধর্মঘট এবং পদযাত্রা করেছি। পরবর্তীকালে আমাদের যে শরিক দলগুলো আছে তাদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বৈঠক করেছি। তাদের সঙ্গে বৈঠক করে গতকাল থেকে নতুন কর্মসূচি শুরু করেছি। গতকাল মহানগরে পদযাত্রা হয়েছে। আজ আবার পদযাত্রা আছে।

ডেইলি স্টার: পদযাত্রায় মানুষের সাড়া পাচ্ছেন কেমন?

মির্জা ফখরুল: প্রচুর সাড়া পেয়েছি। আপনারা নিজেরাই দেখেছেন যে কীভাবে লোকজন এসেছে এ পদযাত্রাগুলোতে। প্রচুর লোকজন আসছে। এরপরে আগামী ১৯ ও ২০ তারিখে এই ২ দিন সারাদেশে জেলা পর্যায়ে এবং মহানগর পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। ২৬-২৭ তারিখেও একই প্রোগ্রাম। যেহেতু মাঝখানে একটু গ্যাপ পড়েছে এটাকে আবার মোবিলাইজ করার জন্য আমরা আবার প্রোগ্রাম দিয়েছি।

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি আন্দোলন করে সরকারের ওপর কঠোর চাপ সৃষ্টি না করা যায় তাহলে সরকার সেটাকে ধর্তব্যের মধ্যে নেয় না। আপনাদের আন্দোলনে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি হচ্ছে?

মির্জা ফখরুল: অবশ্যই। আমরা তো আস্তে আস্তে আন্দোলনের চাপ বৃদ্ধি করছি, ধরন বদলাচ্ছি। আমরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি দীর্ঘ ১৪-১৫ বছর ধরে; বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলন বলতে যেটা বোঝে তা হচ্ছে জ্বালাও-পোড়াও-হরতাল-অবরোধ এসব। আমরা কিন্তু এসব এড়িয়ে যাচ্ছি। আমাদের কর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে, গ্রেপ্তার চলছে, অসংখ্য মামলা হয়েছে। আমরা তবুও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথেই আছি। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আমরা কেমন সাড়া পেয়েছি আপনারা দেখেছেন। একইসঙ্গে আমরা শরিকদেরকে নিয়ে সামনে এগোচ্ছি।

মিডিয়া আশা করে বা অনেক মানুষ আশা করে যে, মুহূর্তের মধ্যে হরতাল-টরতাল দিয়ে এই সরকারকে ফেলে দেওয়া হবে। কিন্তু অতটা সহজ নয়। গোটা পৃথিবীতেই রাজনীতির ধরন পাল্টে গেছে। আমরা সেভাবেই ধীরে ধীরে এগোচ্ছি এবং খুব স্থিরভাবে এগোচ্ছি। আমরা খুবই আশাবাদী যে এই আন্দোলনের চাপের মধ্য দিয়েই এই সরকারকে সরে যেতে বাধ্য করতে পারব।

ডেইলি স্টার: সরকারের পক্ষ থেকে কিংবা সরকারের অনেক নেতা-মন্ত্রীরা বলেন যে বিএনপির আন্দোলনের মুরোদ নেই।

মির্জা ফখরুল: এটা তো তারা বলবেই। তাদের এখন পায়ের নিচে মাটি নেই। বিএনপিকে তারা ব্লেইম করতে চায়, নেতাকর্মীদের হতাশ করতে চায়, সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায়। দুঃখজনকভাবে মিডিয়াতে যারা আছেন তারা মনে করেন, বোধ হয় এগুলোতে আন্দোলন বা মানুষ দমে যাচ্ছে। একটুও দমেনি। আপনি দেখছেন কেমন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। দেখেন সবসময় আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী তারা যে ভাষায় কথা বলছে, তারা যে কতটা নার্ভাস, কতটা যে তাদের পায়ের তল থেকে মাটি সরে গেছে, এটা তাদের কথাতেই বোঝা যায়। ওই কথা বলে তো লাভ নেই যে 'পদযাত্রা আবার শুরু করেছে'। দরকার হলে তো আবার করতে হবেই।

২১ বছর আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছে। ওই শেষের দিকে ছাড়া—আন্দোলন যখন যৌথ ও সর্বদলীয় হলো—কবে তারা আন্দোলনের সফলতা পেয়েছে? তাও ৯১ সালে পায়নি। পরবর্তীকালে ৯৬ সালে সেই আন্দোলন, আগুন, জ্বালাও-পোড়াও, ১৭৩ দিন হরতাল। যেহেতু দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একজন দেশপ্রেমিক এবং মানুষের কথা বুঝতে পেরে তিনি কিন্তু এটাকে মেনে নিয়ে কেয়ারটেকার সরকার দিয়েছেন এবং সেটা করতেও কিন্তু সংসদের নতুন নির্বাচন করতে হয়েছিল। আজকে আমরা যে আন্দোলন করছি তাতে ইতোমধ্যেই এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, এই সরকার মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো কেড়ে নিয়েছে। কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে মানুষ ভোট দিতে পারে না, ভোটের অধিকার নেই।

টাইমিংয়ের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলন নিয়ে আমাদের কৌশল আছে। সেই কৌশলে আমরা স্থিরভাবে এগোচ্ছি। আমরা অস্থির হচ্ছি না। আমরা সরকারের পাতানো ফাঁদে পা দিচ্ছি না। সরকার নিজেরা ও সংস্থা দিয়ে আগুন দিয়ে, জ্বালাও-পোড়াও করে আমাদের ওপর দায় চাপাতে চায়। আমরা সেই সুযোগ দিচ্ছি না। এটাই হচ্ছে তাদের মনোবেদনার কারণ।

ডেইলি স্টার: সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের এখন মূল সমস্যাটা কী? আপনি যেটা বললেন ভোটের অধিকার, সেটা তো আছে। এর বাইরে জিনিসপত্রের দাম, গ্যাস, পানির মূল্য বৃদ্ধি…

মির্জা ফখরুল: সেগুলো তো আছেই। সেগুলো আছে বলেই তো মানুষ এখন সম্পূর্ণভাবে বিক্ষুব্ধ যে সরকার ব্যর্থ। আমরা রাজনৈতিক দলগুলো মনে করি, মানুষ যদি ভোট দেওয়ার সুযোগটা পায় তাহলে তারা তাদের কথাগুলোকে সামনে আনতে পারবে। ভোটের মধ্য দিয়ে সেটা বদলে দিতে পারবে। সাধারণ মানুষ আমাদের কী বলে জানেন? বলে যে, আমাদেরকে শুধু ভোটের ব্যবস্থাটা করে দেন। ভোটটা যেন আমরা দিতে পারি।

এই যে জিনিসপত্রের দাম, মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি এসব তো আমাদের আন্দোলনের মধ্যেই আছে। আমাদের আন্দোলন শুরুই করেছি এগুলো নিয়ে। অনেকে এমন বলে যে, বিএনপি জনগণের কথা বলে না। জনগণের কথা না বললে আমরা কার কথা বলছি?

আমাদের দেশে সাধারণত যারা মধ্যবিত্ত, তারা শহরে বা ঢাকা শহরে আন্দোলনে পরে নামে। একটু দেখেশুনে নামে। আপনারা নিজেরা যদি একটু অবজার্ভ করেন আমাদের প্রোগ্রামগুলো, তাহলে দেখবেন কীভাবে মানুষ আসছে এবং কীভাবে এখানে শ্রমজীবী মানুষ আসছে। আমাদের বক্তব্যের মধ্যেই তো তাদের কথা থাকে। শ্রমজীবী মানুষ আজকে ৩ বেলা খেতে পারছে না, ২ বেলা খাচ্ছে। আগে আমিষ খেতে পারত, এখন আমিষ খেতে পারছে না। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। আছে শুধু দুর্নীতি আর দুর্নীতি। পরিকল্পিতভাবে দেশ থেকে টাকা পাচার করছে।

মিডিয়াকেও এই ফ্যাসিবাদ আক্রমণ করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য আইনগুলোর কারণে মিডিয়াও কিন্তু সেভাবে সবকিছু প্রকাশ করতে পারে না।

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবসময়ের মতো এখনো বিদেশি শক্তি কেন কথা বলল, কী চায়, তাদের কাছে নালিশ করে কিছু হবে না—এই কেন্দ্রিক একটা আলোচনা আছে। আপনারা বারবার খালি বিদেশি শক্তির কাছে নালিশ করছেন—সরকারের এমন অভিযোগ আছে।

মির্জা ফখরুল: আমরা বিদেশিদের কাছে কোনো নালিশ করিনি। আজ পর্যন্ত আমরা নিজেরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কোনো বিদেশির কাছে যাইনি। কেউ আমাদেরকে দাওয়াত করলে আমরা যাই। যখন বলে যে একটু কথা বলব, তখন আমরা যাই। আমরা নিজেরা আগ বাড়িয়ে গেছি, এটা কেউ বলতে পারবে না। ভারত আমাদের দাওয়াত করেছে বলে আমরা গেছি। আমেরিকা আমাদেরকে দাওয়াত করে বলে আমরা গেছি দুয়েকবার। আমরা নিজেরা কখনোই কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইনি।

বিদেশিরা কেন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলে, এটা বিদেশিদের ব্যাপার। গোটা পৃথিবী এখন উন্মুক্ত। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর, তারা যেহেতু গ্লোবাল পলিটিকস করে, তাই তিনি নির্বাচিত হয়ে প্রথমেই বলেছেন যে 'আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি হচ্ছে গণতন্ত্র'। এখন যেখানে গণতন্ত্র নেই, সেখানে তো তারা কথা বলবেই। আর তারা কথা বললে সরকারের গায়ে জ্বালা করে কেন? সমস্যা মনে হলে সমাধান করো, তাহলেই হয়ে যায়।

আওয়ামী লীগ যখন যায়, তারা তো নিজ থেকেই যায়। তারা আমেরিকার অ্যাম্বাসেডরের কাছে নিজ উদ্যোগে গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে গেছে। শুনতে পাচ্ছি ভারত তাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তারা সেখানেও যাবে। আমাকে ডাকলে আমি যাই, না ডাকলে তো যাই না। প্রধানমন্ত্রী তো ৩টা দেশ ঘুরলেন। তিনি কী প্রতিক্রিয়া পেলেন? ৩ জায়গাতেই একই কথা 'উই ওয়ান্ট টু সি এ ফেয়ার ইলেকশন' (আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাই)। কেন? অন্য দেশের বেলায় তো তারা সেটা বলছে না। শুধু আমাদের দেশের বেলায় বলছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বলছে। তার মানে তারা মনে করছে যে, এখানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। যখন তারা বলে যে এই দেশে আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাই, সেটাই হচ্ছে মূল কথা। আর সে কারণেই তাদের গায়ে এত জ্বালা।

ডেইলি স্টার: ৫ সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি নেই। এতে বিএনপির লাভ না ক্ষতি হচ্ছে?

মির্জা ফখরুল: বাংলাদেশে এখন নির্বাচন বলতে কিছু নেই। যা নেই তাতে বিএনপি থাকবে কেন? বিএনপি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের গড়া রাজনৈতিক দল, জনগণের দল। যে ব্যবস্থায় জনগণকে ভোট দিতে দেওয়া হয় না, সেই ব্যবস্থায় বিএনপি অংশ নিতে পারে না। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ই আমাদের মূল লক্ষ্য। লেই লক্ষ্যে অটুট থেকে আমরা রাজনীতি করছি। নিশ্চয় আমরা সফল হবো, মানে বাংলাদেশের মানুষ সফল হবে।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

6h ago