‘জগৎ কুটির’ রিভিউ

অমর্ত্য সেনের ফেলে আসা জীবনের গল্প

বাংলার মাটি-জলে মিশে বেড়ে উঠেছেন অমর্ত্য সেন। নিজেকে তৈরি করেছেন বাঙালির আপনজন হিসেবে। যার মন মননে স্থায়ী আসন পেতে বসে আছে বাংলাদেশ। শৈশব থেকে আজ অবধি পিতৃভূমি বাংলাদেশকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যাননি তিনি। যার প্রমাণ তার সবশেষ প্রকাশিত 'জগৎ কুটীর'।

'অমর্ত্য সেন' নামটি বলার পর এখন আর সেসব বিশেষণের কোনো প্রয়োজন হয় না, কারণ ইতিমধ্যে পুরনো ঢাকার 'জগৎ কুটীর'রের এই সন্তান নিজেকে বিশ্ব নাগরিকে পরিণত করেছেন। আজ সারা পৃথিবীর মানুষ তাকে চেনে-জানে। তাকে পাঠ করছে, গবেষণা করছে। ২০০৪ সালে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। জরিপের বিষয় ছিলো—  সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২৬ মার্চ ২০০৪ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। জরিপে শ্রোতাদের ভোটে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ১৪তম স্থানে আসেন অমর্ত্য সেন। বাঙালি যে তাকে কতটা ভালোবাসে তারই জীবন্ত প্রমাণ হয়তো।

বেড়ে ওঠার কালে তাকে ঢাকার ওয়ারী, শান্তিনিকেতন ও বাবার চাকরিসূত্রে বার্মায় থাকতে হয়েছে। দেশভাগের সময় বাধ্য হয়ে ঢাকা ছেড়ে স্থায়ীভাবে চলে যান ভারতে। কিন্তু প্রিয় ঢাকার স্মৃতি সে তো সহজে ভুলার নয়। বরং মনের মধ্যে যাতনা বয়। তিনি বলছেন— '১৯৪৭-এ দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বদলে গেল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ভয়াবহ রক্তপাত মানুষের মনে নিরবচ্ছিন্ন দুঃখের জন্ম দিল। এর আর একটা মানে হল, আমাদের ঢাকা ছেড়ে যেতে হবে। ঢাকা তখন সদ্য-গঠিত পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। আমাদের পরিবারকে ঢাকা ছেড়ে শান্তিনিকেতনে এসে বসবাস শুরু করতে হল। শান্তিনিকেতন আমার প্রিয়, কিন্তু ঢাকা এবং আমাদের বাড়ি 'জগৎ কুটীর'- এর জন্য আমার খুব মনখারাপ হত। ঝুঁকে পড়া যে চাঁপাগাছটা আমাদের উপরের বারান্দাটাকে মোহিত করে রাখত সেটা আর আমার জীবনের অংশ নয়! ঢাকার পুরনো বন্ধুরা এখন কোথায়, কে কার সঙ্গে খেলছে, আমাদের বাগানের গাছে ধরে থাকা আম আর কাঁঠালগুলোর কী হল—  আমি এই সব ভাবতে থাকতাম। একটা গোটা পৃথিবী আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। শান্তিনিকেতনে আমার জীবন যতই পূর্ণ হয়ে উঠুক না কেন, তা কোনও ভাবেই ঢাকাকে হারানোর দুঃখ ভোলাতে পারেনি।' [পৃষ্ঠা ২১]

অমর্ত্য সেনের পিতৃকুলের আদি বাড়ি মানিকগঞ্জে। তার বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দাদা ভারতীয় দর্শনের প্রখ্যাত পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন, ঠাকুরদা বিচারপতি সারদাপ্রসাদ সেন। ক্ষিতিমোহন সেন  অধ্যাপনা করতেন শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে যখন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন তখন ক্ষিতিমোহন সেন তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন। অমর্ত্য'র মায়ের পরিবারের সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার নামটিও রেখেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এক নোবেল বিজয়ী নাম রেখেছিলেন আরেক ভবিষ্যৎ নোবেল বিজয়ীর। রবীন্দ্রনাথ তার জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন। আলোচ্য বই 'জগৎ কুটীর' এর মূল ইংরেজি বইয়ের শিরোনাম ছিল— হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড । নামটি নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ঘরে বাইরে' থেকে।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অমর্ত্য সেন বলছেন, 'শৈশব থেকেই আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ প্রভাব ছিল। আমার মা অমিতা কেবলমাত্র শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছেন, তাই না। আগেও বলেছি, রবীন্দ্রনাথের নির্দেশনায় কলকাতায় অনুষ্ঠিত নৃত্যনাট্যগুলিতে নিয়মিত মূল চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। আমার দাদু ক্ষিতিমোহন বহু বছর শান্তিনিকেতনে পড়িয়েছেন এবং গবেষণার কাজ করেছেন। ওঁরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্য এবং উত্তর ভারত ও বাংলার গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত কাব্যের উৎস ও সম্ভার সম্পর্কে ক্ষিতিমোহনের পাণ্ডিত্যের ভূয়সী প্রশংসা করতেন এবং তাঁর সেই জ্ঞানের সাহায্য নিতেন। রবীন্দ্রনাথের শেষ ভাষণ 'সভ্যতার সংকট' ছিল এক প্রবল উচ্চারণ। ১৯৪১-এর এপ্রিলে শান্তিনিকেতনে এক সমাবেশে ক্ষিতিমোহনই সেটি পাঠ করেছিলেন।…

... রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অভিঘাত আমাকে নিদারুণ বিষণ্ণ করে তোলে। আমি আসলে রবীন্দ্রনাথকে একজন সাদাসিধে বয়স্ক মানুষ হিসেবেই চিনতাম। ভাবতাম তিনিও আমার সঙ্গে কথা বলতে ভালবাসেন। কিন্তু এখন চেনাজানা সাধারণ গণ্ডি পেরিয়ে ওঁর আদর্শ ও কাজকর্মের কথা শুনতে শুনতে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমার আগ্রহ বাড়ল। মনে হল, যাকে আমি আগে ততটা গুরুত্ব দিইনি সেই মানুষটা সম্পর্কে জানতেই হবে। এভাবে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তাঁর চিন্তাভাবনা, কাজকর্ম নিয়ে জানার আগ্রহ বাড়ে এবং একনিষ্ঠভাবে সে বিষয়ে পড়তে শুরু করি, তাঁকে জানার চেষ্টা আমার সারা জীবনের ব্রত হয়ে যায়।'

১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত অমর্ত্য এবং তার পরিবার বার্মায় ছিলেন। বার্মা থেকে ফেরার সময় তার বয়স ছয় এর কাছাকাছি। ঢাকার মতোই সেখানকার নানা স্মৃতি প্রবলভাবে তিনি ধারণ করেছেন। বার্মার ভাষাও কিছুটা শিখেছিলেন তিনি। জীবনের দীর্ঘ পরিভ্রমণ শেষে যখন তিনি ফেলে আসা দিনগুলির স্মৃতি মন্থন করতে বসেন তখন শৈশবের পুরানো ঢাকা, মানিকগঞ্জের মত্ত গ্রাম, শান্তিনিকেতন কিংবা বার্মার কথাই মনে পড়ে বেশি।

তার শৈশবের প্রিয় বার্মায় যখন সেনাবাহিনী কর্তৃক মুসলিম রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করা হয়, হত্যা করা হয় তখন তিনি ব্যতীত হন। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির তীব্র সমালোচনা করেন। এক সময় দেশটির সেনাশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলায় সু চির প্রশংসা করেছেন। শুধু তাই নয় সু চির নোবেল প্রাইজ গ্রহণের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন অমর্ত্য সেন। সু চির সঙ্গে পরিচয় হওয়াটাকে তিনি সৌভাগ্য হিসেবে বিবেচনা করেন, সেই তিনিই বলছেন— 'বাস্তবিক, সু কি-র নেতৃত্বে কিছু ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে, বিশেষত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে— ভীষণভাবে অসহায় এই বাংলাভাষী মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করতে অস্বীকার করেন তিনি। বর্মার অন্যান্য অনেক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আছে, তাদের প্রতিও সু কি-র আচরণ একেবারেই ভাল দৃষ্টান্ত রাখেনি। রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনী এবং অসহিষ্ণু বৌদ্ধ বর্মীবাহিনী ভয়ানক অত্যাচার চালালেও, রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার ব্যাপারে সু কি কিছুই করেননি, অন্তত এখনও পর্যন্ত না।'

এমন আরও অনেক বিষয়ে এনেছেন 'জগৎ কুটীর'এ। বইটি লিখতে সময় নিয়েছেন প্রায় একযুগ। গ্রীষ্মের ছুটিতে, ইটালির হোটেল ল্য ডিউন-এ, কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে বইটির বেশির ভাগ অংশ লিখেছেন।

কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজকে কেন্দ্র করে অমর্ত্যের রয়েছে অনেক স্মৃতি। ট্রিনিটির শুরুর দিনগুলোর বর্ণনা করছেন লেখক, 'কলেজের কোনও ঘরে নয়, ট্রিনিটিতে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল একটি বাড়িতে, বাড়িওয়ালির তত্ত্বাবধানে। তখন সেটাই রীতি ছিল। প্রথম বর্ষের পড়ুয়ারা কলেজের বাইরে এই রকম বাসায় থাকত; পরে সিনিয়র হলে তারা কলেজের ভেতর জায়গা পেত। আমার এই ব্যবস্থা খুব খারাপ লেগেছিল। সদ্য আগত ছাত্রের পক্ষে অপরিচিত শহরের অজানা জায়গায় থাকাটা বেশি কঠিন। বাড়িটা প্রায়রি রোডে, যে রাস্তাটা বেরিয়েছে হান্টিংটন স্ট্রিট থেকে— জায়গাটা ট্রিনিটি থেকে বেশ খানিকটা দূরে।'

একসময় এই ট্রিনিটিই তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এরমধ্যে পাকিস্তানের মাহবুব উল হক, শ্রীলঙ্কার লাল জয়বর্ধন, ইজরাইলের মাইকেল ব্রুনো, সাউথ আফ্রিকার ডেভিড এপস্টাইন ও অ্যালান হেস, নরওয়ের সালভে সালভেসেন, ফিলিফিন্সের হোসে রোমেরো, জাপানের হিসাহিকো ওকাজাকি, থাইল্যান্ডের আনন্দ পানিয়ারাচুন। এছাড়া বিখ্যাত ইতিহাসবিদ সাইমন ডিগবি ও দার্শনিকেইয়ান হ্যাকিং অন্যতম। তারা সবাই পৃথিবীখ্যাত মানুষ।

তার বন্ধুদের সর্ম্পকে তিনি বলছেন, 'ট্রিনিটির এই বিদেশি গ্যাং-এর সদস্যরা প্রত্যেকেই পরবর্তী কালে নিজেদের কর্মজীবনে অত্যন্ত সফল। আনন্দ দু'বার তাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়। চাকো ছিল প্রথম সারির কূটনীতিক— ও কিছুদিনের জন্য জাপানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দফতরের প্রধান হিসাবেও কাজ করেছে। অবসরগ্রহণের পর চাকো টোকিয়োর ওকাজাকি ইন্সটিটিউটের নির্দেশক হয়— প্রতিষ্ঠানটির নাম ওরই নামে। হোসে রোমেরো রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাজ করেছে।'

বইতে লেখকের ঢাকা ও মান্দালয়ের স্মৃতি, পারিবারের গল্প, বাংলার নদ-নদীর স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিনিকেতন, দুর্ভিক্ষ, বাংলাদেশের ধারণা, ব্রিটেন ও ভারত, কলকাতার নাগরিকতা, কলেজ স্ট্রিট, কার্ল মার্কস, ট্রিনিটি কলেজের স্মৃতি, প্রিয় সব বন্ধু ও  অর্থনীতি, রাজনীতি, ইউরোপ-আমেরিকাসহ অসংখ্য বিষয় স্থান পেয়েছে। লেখক যখন অর্মত্য সেন তখন প্রাসঙ্গিক কারণেই 'জগৎ কুটীর' আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

৫টি পর্বে ২৬টি শিরোনামে বইটি সাজানো। অতি সংক্ষিপ্ত প্রতিটি শিরোনাম অত্যন্ত চমৎকার। লেখকের দীর্ঘ জীবনের প্রাসঙ্গিক বিষয় আন্তরিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বইটি পড়তে গিয়ে কখনো মনে হয়নি এটি একটি অনূদিত বই। মোট ১৭জন অনুবাদক মূল ইংরেজি বই হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ডকে বাংলায় 'জগৎ কুটীর' এ রূপান্তর করেছেন। বাংলা সংস্করণটি সম্পাদনা করেছেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, কুমার রাণা ও সৌমিত্র শংকর সেনগুপ্ত। তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ বইটি দ্রুতসময়ে পাঠকের হাতে পৌঁছে যায়। 

অমর্ত্য সেনে আগ্রহী তো বটেই এছাড়া সমাজ-বিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি এমন কী ফিকশন পাঠে আগ্রহীদেরও বইটি ভালো লাগবে। বইটি শেষ করতে গিয়ে প্রায় দুই যুগ আগে পড়া যাযাবর (বিনয় মুখোপাধ্যায়) এর 'দৃষ্টিপাত' বইয়ের কথা মনে পড়ছে। 'দৃষ্টিপাত' পড়ে তখন মনে হয়েছিল আমি একশত বই পাঠ করেছি একসঙ্গে।

Comments

The Daily Star  | English
health reform

Priorities for Bangladesh’s health sector

Crucial steps are needed in the health sector for lasting change.

15h ago