লাইফস্টাইলজনিত রোগ: রাষ্ট্র ও ব্যক্তির দায়

গত দেড় দশকে বাংলাদেশের রোগচিত্র বদলে গেছে। মানুষ ডায়রিয়া, আমাশয় বা বসন্ত রোগের মতো সংক্রমক রোগের গণ্ডি পেরিয়ে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো অসংক্রমক রোগের খপ্পরে পড়লো। ভারতীয় সাংবাদিক দীনেশ সি. শর্মা: নো ইয়র হার্ট: দ্য হিডেন লিঙ্কেজ বিটুইন ইওর বডি এন্ড পলিটিকস অব দ্য স্টেট শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। এতে তিনি দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় নীতি ও ব্যক্তি অভ্যাসের দায় কীভাবে জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার পর্যবেক্ষণ সমভাবে প্রযোজ্য।

গত দেড় দশকে বাংলাদেশের রোগচিত্র বদলে গেছে। মানুষ ডায়রিয়া, আমাশয় বা বসন্ত রোগের মতো সংক্রমক রোগের গণ্ডি পেরিয়ে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো অসংক্রমক রোগের খপ্পরে পড়লো। ভারতীয় সাংবাদিক দীনেশ সি. শর্মা: নো ইয়র হার্ট: দ্য হিডেন লিঙ্কেজ বিটুইন ইওর বডি এন্ড পলিটিকস অব দ্য স্টেট শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। এতে তিনি দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় নীতি ও ব্যক্তি অভ্যাসের দায় কীভাবে জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার পর্যবেক্ষণ সমভাবে প্রযোজ্য।

দিনেশ সি. শর্মার পর্যবেক্ষণ এতোটাই তিক্ষ্ম যে চলমান রোগতত্ত্বের বিস্তৃতি ও প্রকৃতি নিয়ে বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। তিনি সংক্রমক রোগের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষ কীভাবে অসংক্রমক রোগের জগতে প্রবেশ করলো তার অন্তর্নিহিত কারণগুলো তুলে ধরেছেন।

আধুনিক রোগতত্ত্বে অসংক্রমক বা নন-কমিউনিকেবল রোগকে বলা হয় লাইফস্টাইলজনিত রোগ। যাপিতজীবনকে ঘিরে এসব রোগের জন্ম ও ব্যাপকতা। লাইফস্টাইলজনিত রোগ একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত; যেমন-ডায়বেটিস,উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক ও হৃদরোগ এসব রোগ যুথবদ্ধভাবে শরীরে বাস করে। এদের ভেতরে রয়েছে বিশেষ পরার্থবোধ। একটি আরেকটিকে ডেকে আনে। ব্যক্তির জীবনযাপন, অভ্যাস এবং রাষ্ট্রীয় নীতি মিলে লাইফস্টাইলজনিত রোগের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

ব্যক্তি অভ্যাসের দায়

হৃদযন্ত্র প্রতিমিনিটে ৬০ থেকে ৭০ বার পাম্প করে এবং দিনে ৭ লিটার রক্ত সঞ্চালন করে। অথচ হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ব্যক্তির আচরণ অত্যন্ত নির্বিচার। খাদ্যাভ্যাস, চর্বিযুক্ত খাবার, ধুমপান এবং দূষিত পানি ও বাতাস, ধোঁয়াসহ নানাবিধ ক্ষতিকর উপাদান সহজেই শরীরে অনুপ্রবেশ করে তা বিপর্যস্ত করে তুলছে। দিনেশ উল্লেখ করেন, কেবল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ভারতে প্রতিবছর ৩০ লাখ লোক মারা যায়। ভারতের অনুপাতে বাংলাদেশেও এ হিসাব কম হবে না। 

হৃদরোগের চিকিৎসাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সুরম্য সব বেসরকারি হাসপাতাল। হৃদরোগের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুলও বটে। এ সংক্রান্ত মেডিকেল ব্যবসার আকারও একবারে ছোট নয়। হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যয় সবার জন্য বহন করা সম্ভব নয়। ভারতের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা দেবি শেঠি বলেছেন- যে সমাধান মানুষের জন্য অ্যাফটেবল নয় তা কোনো সমাধান নয়। অনেক বড় চিকিৎসাকেন্দ্র, অনেক উন্নত সেবা কিন্তু সাধারণ জনগণ তা অ্যাফোর্ড করতে পারছে কিনা সেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

ব্যক্তি অভ্যাসের দায় ও পারিপাশ্বিকতা হৃদরোগের উর্বরভূমি তৈরি করছে। যাদের বিত্ত আছে তারা চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারেন। কিন্তু সহায়সম্বলহীনদের তা অনেক কঠিন।

দেশে চাহিদার তুলনায় সরকারি সেবা অপ্রতুল। আর বেসরকারি সেবা মূলত অর্থনির্ভর। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। যেমন- হার্টের রিং-এর মূল্য নিয়ে কতো কথা হয়। কিন্তু এর সুরাহা কোথায়?

অন্যদিকে, জনগণ বুঝে বা না বুঝেই বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থায় ঢুকে পড়লো; প্যাকেটজাত খাবার, ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড, কোমল পানীয়, ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক ও অফিস পরিসরে অপরিহার্য হয়ে উঠলো। দিনেশ তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, কেবল ভারতে ২০০৩ সালের তুলনায় ২০০৮ সালে রীচফুড গ্রহণের জন্য হোটেল, রেস্টুরেন্টে ভোক্তার প্রবেশের হার বেড়েছে ছয় গুণ। এটি পনের বছর আগের তথ্য। নিশ্চয় পরিস্থিতি আরও অনেক দূর গড়িয়েছে।

বাংলাদেশে প্রত্যন্ত গ্রামে চলে গেছে কোমল পানীয়, চিপস, ফাস্টফুড, রিচফুড পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি ঘোষণা মতে দেশ শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। গ্রামীণ পর্যায়ে বেড়েছে ফ্রিজের ব্যবহার। ফলে বোতল ও প্যাকেটজাত খাবার সংরক্ষণ সহজ হয়েছে। মানুষের খাবার অভ্যাসে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে রীচফুডের ব্যবহার বেড়েছে।

একই সঙ্গে গ্রামে সড়ক যোগাযোগ নেটওর্য়াক বিস্তৃত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ২০১৬-এ নিউ রুরাল এক্সসেস ইনডেক্স: মেইন ডিটারমিনেন্ট এন্ড কোরিলেশন টু পোভাটি শীর্ষক সমীক্ষায় দেখিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ দুকিলোমিটারের মধ্যে পাকা সড়ক পায়-যা দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। এ সংযুক্তি আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির বিভিন্ন সূচকে ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের বাজার প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত করতে সহায়তা করছে। রীচফুড গ্রহণের জন্য হোস্টেল বা রেস্টুরেন্টে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে-যা সামাজিক মর্যাদার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে লাইফস্টাইলজনিত রোগ বিস্তৃতির সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের আয় বেড়েছে (যদিও করোনার সময়ে তা কিছুটা কমেছে)। কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের ব্যাপারে ব্যক্তির সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। ব্যায়াম বা শরীরচর্চার জন্য কমিউনিটি স্পেস ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

পরিবর্তিত স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে জনগণের গড়পড়তা ওজন বেড়েছে যাকে বলা হচ্ছে ওবেসিটি। খাদ্যভ্যাসে পরিবর্তন, সীমিত কায়িকশ্রম, টেলিভিশন, মোবাইল ও কম্পিউটার দেখার অধিক প্রবণতা জনস্বাস্থ্যকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক জঞ্জাল অবলিলায় ঢুকে পড়ছে গৃহে, শরীর ও মনে।

সমাজ ক্রমশ মেডিকেল ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হচ্ছে। ওষুধের দোকার, ক্লিনিক, প্যাথলজি সেন্টার এখন স্থানীয় পর্যায়ে বিস্তৃত। মানুষের ওষুধ সেবনের প্রবণতা বেড়েছে বহুগুণ। বিশেষত ডাক্তারদের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া নানারোগ ব্যাধিতে ওষুধ বিক্রেতাদের শরণাপন্ন হওয়া বাড়ছে। এমনকি যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে-যা জনস্বাস্থ্যর জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়।

রাষ্ট্রের দায়

জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় রাষ্ট্রের রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও বিনিয়োগের ঘাটতি। রয়েছে উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা ও জবাবদিহিতার সংকট। স্বাস্থ্যখাতকে ঘিরে বেসরকারি খাতের বিস্তৃতি এক উদ্বেগজনক বিষয়। বেসরকারি খাতের চিকিৎসা ব্যয়, মান ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের ভূমিকা জোরদার করা প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাসহ জনপরিসরগুলো তৈরি করা দরকার। তা দরকার শহর-গ্রাম উভয় পরিসরে।

জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত নীতিপরিকল্পনায় পরিবর্তিত স্বাস্থ্য পরিস্থিতির আলোকে হালনাগাদ করা দরকার। আজও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি কমিউনিকেবল রোগের প্রভাবে প্রভাবিত। বদলে যাওয়া রোগচিত্রের কোনো বিশেষ প্রভাব নীতিতে দেখা যায় না।

বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যয়, ঔষধ, হাসপাতাল ও ডাক্তারদের পেশাগত উৎকর্ষ ও নৈতিকতা এবং জাতীয় স্বাস্থ্য ইন্সুরেন্সের অভাব মিলিয়ে আজকের রুগ্ন জাতীয় স্বাস্থ্যচিত্র। আবারো বলি তা আরও গতিশীল করছে চিকিৎসা সেবার বেসরকারীকরণ। ভেজাল খাদ্য, পানি ও বায়ু দূষণ এবং রেডিও-টেলিভিশন থেকে নিয়ত বিচ্ছুরিত দুঃচিন্তা ও হতাশা এবং ভোগবাদিতার বাহারি প্রচারণা জনস্বাস্থ্যের ওপর যে অভিঘাত সৃষ্টি করছে তা মোকাবেলায় রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব রয়েছে।

রাষ্ট্র ও ব্যক্তি অভ্যাস লাইফস্টাইলজনিত রোগব্যাধিতে অভিবাদন জানাচ্ছে। লাইফস্টাইলজনিত রোগের চূড়ান্ত খাবার প্রাণভোমরা। বিশেষত গরিব, নিম্নবিত্ত ও গ্রামের অসহায়-দুঃস্থ মানুষেরা যখন লাইফস্টাইলজনিত রোগে আক্রান্ত হন তখন তা কঠিন পরিস্থিতি তৈরি। কারণ তারা এসব রোগের চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারেন না।

দশটি রোগকে লাইফস্টাইলজনিত রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যার মধ্যে অন্যতম- হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ওবেসিটি, ডায়াবেটিক, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা। ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রাণ কেড়েছে এসব রোগে। শীর্ষ দশ রোগের তালিকা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেখানে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় হৃদরোগে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্ট্রোক।

রাষ্ট্র ও ব্যক্তি অভ্যাস মিলিয়ে লাইফস্টাইলজনিত রোগের ওয়ারেন্টবিহীন গণগ্রেফতারেরক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে রাষ্ট্র ও জনগণ উভয়ের দায় রয়েছে।

Comments