মে দিবস

গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতি কেবল কাগজে-কলমে

রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও অবহেলায় ৮ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’
৯৬ শতাংশ গৃহকর্মী নির্যাতিত হলেও কারো কাছে অভিযোগ করেননি। প্রতীকী ছবি। ছবি: স্টার

২০ লাখেরও বেশি গৃহকর্মীর অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিতে করা হয়েছিল 'গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫'। এই গৃহকর্মীদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। তবে, সরকারের সদিচ্ছার অভাব ও অবহেলায় বিগত ৮ বছর ধরে এই নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

গৃহকর্মী, নিয়োগকর্তা এবং আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাসহ প্রধান অংশীজনেরা এখনো এই নীতি সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। এই নীতি সম্পর্কে তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা আবুল হোসেন জানান, প্রতি ৬ মাস পরপর বৈঠকের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও নীতি বাস্তবায়নের তদারকির জন্য ৩ বছর আগে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল একটি বৈঠকও করতে পারেনি।

সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক এবং ইউএনওদের নেতৃত্বে যেসব মনিটরিং সেল গঠন করার কথা ছিল, সেগুলো গঠনই করা হয়নি।

পরিদর্শন দলের অনুপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আবুল হোসেন বলেন, 'পরিদর্শন দলে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং স্থানীয় সরকারের অধীনে সরকারি প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল।'

গত বছর হাইকোর্ট গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিকে 'অসম্পূর্ণ' ও 'অস্পষ্ট' বলে উল্লেখ করেন। কারণ এই নীতিতে ভুক্তভোগীর জন্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ, অর্থপ্রদান পদ্ধতি, ছুটির সংখ্যা এবং ছুটি না পেলে সে বিষয়ে আপিল প্রক্রিয়ার মতো নির্দিষ্ট তথ্য নেই।

ফলস্বরূপ, গৃহকর্মীরা এখনো যৌন নির্যাতন (৪ শতাংশ), শারীরিক নির্যাতন (২১ শতাংশ), মানসিক নির্যাতন (৬৭ শতাংশ) এবং মৌখিক নির্যাতনসহ (৬১ শতাংশ) বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ অ্যান্ড ডিনেটের সাম্প্রতিক এক জরিপে।

৯৬ শতাংশ গৃহকর্মী এসব নির্যাতনের পর কারো কাছে অভিযোগ করেননি। কারণ গৃহকর্মীদের ওপর পারিবারিক নির্যাতন তাদের কাছে নিয়মিত ঘটনা হিসেবে পরিণত হয়েছে এবং তারা এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না।

প্রায় ৯৯ শতাংশ গৃহকর্মী এই নীতি সম্পর্কে জানেন না। নিয়োগকর্তাদের মধ্যে মাত্র ৬৬ শতাংশ এই নীতি সম্পর্কে কিছুটা জানেন।

'বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের ওপর গবেষণা' প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, নীতিতে ১৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটির নিশ্চয়তা থাকলেও মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ গৃহকর্মী বৈতনিক ছুটি পান। ৮৭ শতাংশ গৃহকর্মীর কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রতিদিন ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন।

গৃহকর্মীদের অর্ধেকেরও বেশি হাঁপানি, চর্মরোগ, জ্বর ও প্রস্রাবে ইনফেকশনের মতো স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছেন এবং তাদের বেশিরভাগই ফার্মেসিগুলো থেকে চিকিৎসা নেন।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ গৃহকর্মী প্রতি মাসে গড়ে ৫ হাজার ৩১১ টাকা আয় করেন। গৃহকর্মীদের ৯৬ শতাংশ মনে করেন, এই আয় তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অপর্যাপ্ত। এ ছাড়া, এই শ্রমিকদের ২৩ শতাংশের গত বছরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে খরচ হয়েছে ২৫ হাজার ৯৯৯ টাকা।

বিদ্যমান নীতি ও আইন বাস্তবায়ন, ক্ষতিপূরণ ও বেঁচে থাকা অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন, সমস্যা সমাধানের জন্য একটি ন্যূনতম মজুরি প্রতিষ্ঠা ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মামলা পরিচালনার জন্য আইন প্রয়োগকারীদের প্রশিক্ষণ এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে জরিপ প্রতিবেদনে।

এই নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য গৃহকর্মীদের বিদ্যমান শ্রম আইনের আওতায় আনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।

তিনি বলেন, 'আইন ছাড়া সরকারকে জবাবদিহি করা যায় না।'

তিনি আরও বলেন, 'গৃহকর্মীদের কাজের ধরন এবং নিয়োগকর্তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার বৈচিত্র্যের কারণে তাদেরকে ন্যায্য বেতন ও প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দেওয়া একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন এমপ্লয়মেন্ট গ্রেড থাকা উচিত এবং চাকরির নিরাপত্তাসহ আনুষ্ঠানিক নিয়োগের ব্যবস্থা করা উচিত।'

'বিশেষ করে শিশু গৃহকর্মীদের নিবন্ধন ও নিয়মিত পরিদর্শন হওয়া উচিত। এর ফলে তাদের ওপর নির্যাতনের দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। কারণ আমরা দেখেছি শিশু গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়, কিন্তু সেগুলো বিচারের মুখ দেখে না।,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Shutdown is another economic peril

Vowing to continue an indefinite work stoppage and stage a protest march on tax offices, the NBR Reform Unity Council has intensified its demands

8h ago