‘ঈদ সালামিটা ভালোবাসার প্রকাশ’

এটা বাধ্যতামূলক কোনো রীতি নয়। ভালোবাসা আর সম্পর্কের জায়গা থেকেই সালামি দেওয়া হয়।

ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে বড়রা সাধারণত ছোটদের উপহার হিসেবে টাকা দিয়ে থাকেন, যা 'সালামি' নামে প্রচলিত। অনেকে একে 'ঈদি' বা 'ঈদিয়া'ও বলেন।

এটা বাধ্যতামূলক কোনো রীতি নয়। ভালোবাসা আর সম্পর্কের জায়গা থেকেই সালামি দেওয়া হয়।

সালামির ক্ষেত্রে সর্বপ্রথমেই যে বিষয়টি চলে আসে তাহলো, সালামির টাকা নতুন হওয়া চাই। আর এ জন্যই অনেকে ব্যাংক বা অন্য কোনো উৎস থেকে নতুন নোট সংগ্রহ করেন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সালামিরও পরিবর্তন এসেছে। এখন অনলাইনেও লেনদেন হয় সালামি। বিশেষ করে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে ঈদ সালামি নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতার তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, একুশে পদক পদকপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী দিলারা জামান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।

তাদের মতে, ঈদ সালামি হলো ছোটদের প্রতি বড়দের স্নেহ ও ভালোবাসার প্রতীক। এটি সম্প্রতির বন্ধন তৈরি করে।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম

বাবা-মা, নানা-নানী, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে মানুষ সালামি পায়। আমি অনেক ছোট থাকতেই আমার মা মারা যান। বাবা মারা গেছেন যখন আমি ক্লাস ফাইভে। আমি বাবা-মার কাছে সালামি পাইনি। তবে আমি সালামি দেই। আমার নাতি-নাতনিদের, আশেপাশের বাচ্চাদের, আমার ড্রাইভারের ছেলে-মেয়ে, বাসার কেয়ারটেকারের ছেলে-মেয়েদেরকে সালামি দেই।

সালামি এক ধরনের ভালোবাসার প্রকাশ। বাচ্চারা সালামি নিয়ে গল্প করে, বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করে, অনেক আনন্দ পায়। সালামি একটা আনন্দের উপকরণ। এর মধ্যে দিয়ে ভালোবাসা, স্নেহ প্রকাশ পায়। সম্প্রতির বন্ধন বৃদ্ধি করে। একটি ছোট শিশুর মুখে যখন হাসি দেখি, তখন মনটা ভরে যায়। এই যে নির্মল হাসি, তা কোনোকিছু দিয়েই পরিমাপ করা যায় না। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। ছোটদের সঙ্গে বড়দের এক ধরনের আত্মার মিলন হয়। সালামির পর বাচ্চারা যে হাসি দেয়, খুশি মনে দৌড়ে চলে যায়—এটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।

ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ঈদ মিলনের উৎসব। ঈদে ছোটদের সালামি দিলে উৎসবের মাত্র বেড়ে যায়। সালামি পেলে বাচ্চাদেরও ঈদের আনন্দ বেড়ে যায়।

সালামির মাধ্যমে বাচ্চাদেরকে এক ধরনের আচরণ শেখানোও হয়। তাদের শেখানো যায়, তোমার চেয়ে বয়সে বড়দের সম্মান করো, তাহলে তারা তোমাদের ভালোবাসবে। আমাদের প্রজন্মগুলোর মধ্যে এক ধরনের গ্যাপ তৈরি হয়। সালামি সেটা কিছুটা পূরণ করে দেয়।

আমি ছোটবেলায় দেখেছি, পাড়াপ্রতিবেশিরা একজন আরেকজনের বাড়িতে যাচ্ছেন, খাচ্ছেন, ছোটদের সালামি দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে এক ধরনের সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি হতো।

সালামির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এটি দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের মূল্যবোধ কাজ করে। মানুষকে দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে। যে সালামি পাচ্ছে, সে কিন্তু বড় হয়ে অন্যদের সালামি দেওয়া শিখবে।

আমি ছোটবেলায় ১ টাকা করে সালামি পেতাম। তাতেই মনে হতো, আমার হাতে অনেক টাকা।

ঈদ সালামি আমাদের এক ধরনের ঐতিহ্য। এটা হারিয়ে যেতে দেওয়াটা উচিত হবে না। তবে সালামি যেন কারো ওপর চাপ সৃষ্টি না করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এটি দিলে মানুষের মধ্যে একটি সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক যেমন তৈরি হয়, তেমনি সম্মানও বাড়ে।

সালামিটা শুধু পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে যারা আমাদের দেখাশোনা করেন এবং আশেপাশের মানুষদের মাঝেও ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। আমার বাবা-চাচারা এটা খুব মানতেন। তারাও সালামি পেতেন। এটা অনেক পুরনো একটি ঐতিহ্য।

রাশেদা কে চৌধুরী

ঈদে ছোটদের উৎসবের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় সালামি। সালামি দেওয়া ও পাওয়ার মধ্যে এক ধরনের নির্ভেজাল আনন্দ রয়েছে। আমাদের সময় বড়রা পকেট ভর্তি করে কয়েন নিয়ে আসতেন। আমাদেরকে ১ সিকি, ১ আধুলি দিয়ে সালামি দিতেন। আমাদের ছোটদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হতো, কে বেশি সালামি পেলাম সেটা নিয়ে। সেই কয়েনগুলো মাটির ব্যাংকে জমিয়ে রাখতাম, আইসক্রিম খেতাম, বেশি টাকা হলে বন্ধুদের সঙ্গে চাইনিজ খেতাম।

এখনও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যাদের বাচ্চা আছে, তাদেরকে সালামি দেই। পাশাপাশি বাসায় যারা কাজ করেন তাদের ছেলে-মেয়ে, কেয়ারটেকারের ছেলে-মেয়ে এবং আমার সঙ্গে যারা কাজ করেন তাদেরকেও সালামি দেই।

আমার মনে হয়, পরিবারের পাশাপাশি দরিদ্র মানুষদেরও সালামি দেওয়া উচিত। ঈদের দিনে যদি কোনো ভিক্ষুক টাকা চায়, সেটি কিন্তু আমরা ভিক্ষা হিসেবেই দেই। কিন্তু সেটি যদি সালামি হিসেবে দেই, তাহলে যিনি টাকা চাইলেন তিনি অনেক খুশি হবেন। সালামিটা মূলত ভালোবাসার প্রকাশ। এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে ছোটদের প্রতি বা সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষদের প্রতি।

দিলারা জামান

ছোটবেলায় ১ আনা, ২ আনা, ১ টাকা সালামি পেতাম। আমার মনে আছে, যখন ক্লাস থ্রিতে পড়তাম তখন আমার এক নানু আমাকে ১ টাকা সালামি দিয়েছিলেন। তখন ১ টাকা মানে অনেক কিছু। ১ আনা দিয়ে মুড়ি-মুড়কি, আইসক্রিম পাওয়া যেত।

এখন আমি আমার নাতি-নাতনিদের সালামি দেই। আগেই ব্যাংক থেকে নতুন টাকা সংগ্রহ করে রাখি। ঈদের দিন বা তারপরে সালামি দেই। ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত সালামি দেই। মেয়ের জামাইরা সালাম দিলে তাদের সালামি দেই। তারা নিতে চায় না, তবুও দেই।

সালামি দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের এখানে চলে আসছে। এটি ছোট ও বড়দের মধ্যে সম্পর্কের একটি বন্ধন তৈরি করে, ছোটদের ঈদের আনন্দ আরও বাড়িয়ে তোলে।

ইলিয়াস কাঞ্চন

আমি ছোটবেলায় বাবা-মা, চাচা-চাচিসহ আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে সালামি পেতাম। আর এখন ছোট ভাই-বোন ও বাচ্চাদের সালামি দেই।

ছোটবেলায় যারা বেশি সালামি দিতেন তাদেরকে বেশি ভালো লাগতো, আর যারা কম দিতেন তাদেরকে কিপ্টা মনে হতো। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে আমি এখন সালামি দেই। আমার ভাই-বোনরা এখন বড় হয়ে গেছে। তারা মুখে বলে যে সালামি দেওয়া লাগবে না। কিন্তু মনে মনে কিন্তু ঠিক আশা করে। তাই বড় হয়ে গেলেও তাদেরকে সালামি দেই। সালামি আসলে কেউ চায় না। তবে মনে মনে আশা ঠিকই করে।

আমি ছোটবেলায় সালামির টাকাগুলো মাটির ব্যাংকে জমাতাম। যখন অনেক টাকা হতো, তখন সেগুলো দিয়ে কিছু একটা কিনতাম। ঈদ সালামি আসলেই আনন্দ অনেক বাড়িয়ে দেয়। ছোট ও বড়দের মধ্যে এক ধরনের সেতু বন্ধন তৈরি করে। এটা কেউ পাওয়ার পর তার মুখে যে হাসিটা দেখা যায় তার মূল্য অনেক বেশি।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh approves export of 3,000 tonnes of hilsa to India for Durga Puja

The government has approved the export of 3,000 tonnes of hilsa fish to India on the occasion of Durga Puja, the commerce ministry said in a statement today

1h ago