ঈদের চাঁদ দেখা ও সালামির ঐতিহ্য

প্রতীকী ছবি | সংগৃহীত

মুসলমানদের প্রধান বাৎসরিক উৎসব ঈদুল ফিতর, যা বাংলাদেশে পরিচিত রোজার ঈদ নামে। মূলত রমজানের পর এই ঈদোৎসব আসে বলেই এই নামকরণ। আরবি শাওয়াল মাসের পহেলা তারিখে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। আর আরবি মাসের হিসাব মূলত চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। ফলে ঈদ কবে উদযাপিত হবে, তা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। এজন্যই শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা ঈদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ঈদ মানেই আনন্দ, উল্লাস আর উৎফুল্লতা। শাওয়াল মাসের পহেলা তারিখেই যেহেতু ঈদ, সেহেতু শাওয়ালের চাঁদ মানেই ঈদের চাঁদ। সেজন্য ঈদের আগের দিন রাতকে বলা হয় 'চাঁদরাত'। চাঁদ দেখাকে কেন্দ্র করেই মূলত শুরু হয় আমাদের ঈদ উদযাপনের পালা। ঈদের চাঁদ দেখার জন্য ছোট্ট ছেলে-মেয়ে থেকে শুরু করে মুরুব্বি পর্যন্ত সবাই মাগরিবের পর তাকিয়ে থাকে পশ্চিমাকাশে। চাঁদের বাঁকা রেখা ফুটে ওঠা মাত্র‌ই সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের ফল্গুধারা।

চাঁদ দেখাকে কেন্দ্র করে এই আনন্দ-উত্তেজনা আজকের নতুন নয়, বরং বহু পুরোনো রীতি। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে, মীর্জা নাথান রচিত বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ 'বাহারিস্তান-ই গায়বী'তে পাওয়া যায় এই রীতির কথা। সেখানে উল্লেখ আছে: 'দিনের শেষে সন্ধ্যায় নতুন চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে রাজকীয় নাকারা বেজে ওঠে এবং গোলন্দাজ সেনাদলের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ক্রমাগত তোপ দাগানো হয়।' অর্থাৎ, সেনাদলের বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে নগরবাসীকে বুঝিয়ে দেওয়া হতো, শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেছে, আগামীকাল ঈদ।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায় চাঁদ দেখা নিয়ে এমন উৎসবমুখর ঘটনার। তিনি লিখেছেন: 'ঈদটা সত্যি ছিল আনন্দের। প্রথমেই মনে পড়ে ঈদের চাঁদ দেখার প্রতিযোগিতা। সূর্য অস্ত যেতে না যেতেই তৃষিত দৃষ্টি নিয়ে সকলে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতাম। মনে হতো ছাদে উঠে দেখতে পারলে আকাশের একটু কাছে পৌঁছানো যেতো এবং তাতে দৃষ্টিসীমার মধ্যে চাঁদের এসে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। অভিভাবকেরা সহজে সেখানে উঠতে দিতে চাইতেন না—পাছে আকাশের দিকে চোখ মেলে নড়াচড়া করতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে যাই। বাড়ির সামনের ফুটপাথ থেকে চাঁদ দেখা না গেলে ভাবতাম, বাড়ির পেছন দিকে রান্নাঘর বা তার কাছ থেকে তাকালে হয়তো চাঁদ দেখা যাবে। রমজানের চাঁদ দেখারও একটা প্রতিযোগিতা চলতো, তবে ঈদের চাঁদ দেখার উৎসাহ ছিল বহুগুণে বেশি। চাঁদ দেখতে না পেলে একটু বিমর্ষ হতাম। বন্ধুরা এই উৎসাহের সুযোগ নিয়ে ঠকাতে চাইতো। বলতো, "ওই তো চাঁদ"। "কোথায়? কোথায়?", "ঠিক আমার আঙুলের সোজাসুজি দেখ্, দেখতে পাবি"। প্রায়ই কোনো বন্ধুর নির্দেশমতো এদিক-ওদিক তাকিয়েও হয়তো দেখতে পেতাম না। যখন দেখতে পেতাম, তখন কী আনন্দ!

'প্রত্যাশিত দিনে চাঁদ দেখতে না পেলে পরদিন চাঁদ উঠবে বলে ধরে নেওয়া হতো। সেইমতো বাড়িতে শুরু হতো নানা আয়োজন। পরের সন্ধ্যায় চাঁদ উঠলে মা কী বোনেরা খালি চোখে চাঁদ দেখে দোয়া-দরুদ পড়তো। তারপর চোখের সামনে শাড়ির আঁচল ধরে সেদিকে আবার দেখতো। কাপড়ের ভিতর দিয়ে দেখা গেলে বুঝতে হতো সেটা দ্বিতীয়ার চাঁদ—ঈদের চাঁদটা আসলে উঠেছিল আগের সন্ধ্যায়, আমাদের কাছে ধরা দেয় নি।' (আনিসুজ্জামান: ২০০৩, ৭০)

আনিসুজ্জামানের এই লেখা থেকেই স্পষ্ট যে, কতটা উৎফুল্ল হয়ে উত্তেজনাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো চাঁদ দেখাকে কেন্দ্র করে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে ঈদের চাঁদ দেখার যে মধুর স্মৃতি, তাই মূলত তিনি বর্ণনা করেছেন। এমন মধুর স্মৃতি বোধহয়, প্রতিটি বাঙালি মুসলমানের স্মৃতির ভাণ্ডারে তাজা আছে।

কথাসাহিত্যিক আবু রুশদের স্মৃতিতেও অমলিন ছিল কৈশোরে ঈদের চাঁদ দেখার স্মৃতি। লিখেছেন তিনি: 'যেদিন ঈদের চাঁদ দেখা দিতো সেটা ছিলো মহা স্ফূর্তির সময়। সাধারণত দুই ঈদের ব্যবধানে আমরা নতুন কাপড় ও জুতো পেতাম। খুব বাহারী কিছু না। পাজামা ফুজি সিল্স এর পাঞ্জাবী আর চপল। সেগুলি কিনতাম তখনকার মধ্যবিত্তদের জন্য খুব চালু ডিপার্টমেন্ট স্টোর ওয়াসেল মোল্লা থেকে। নতুন কাপড় পেলে উৎসাহের পরিমাণ অবশ্য অনেক বেড়ে যেতো। আমার নিজেরটা আমি নিজেই সাবান দিয়ে খুব যত্নের সঙ্গে কাঁচতাম তারপরে ইস্ত্রি করিয়ে রাখতাম। নতুন স্যাণ্ডেল হলে তাতেও কালি লাগিয়ে ব্রাশ ও পুরানো গরম কাপড়ের টুকরো দিয়ে তা পরিষ্কার করে স্যাণ্ডেলটাকে ঝকঝকে তকতকে করে তুলতাম।' (রুশদ: ১৯৮৯, ৭৮)

ঈদের চাঁদ নিয়ে কবি শাহাদাত হোসেন কবিতা লিখেছিলেন, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় (১৩৪৫/১৯৩৮)। প্রথম চার লাইন:

'আজি শওয়ালের দ্বিতীয়ার চাঁদ বহিয়া এনেছে দ্বারে

খুশির স‌ওদা, খোশ আমদেদ মণি-মঞ্জুষা ভারে।

দুনিয়া জাহানে ন‌ওরোজ আজি জাগ্রত মুসলিম

কোলাকুলি আর কুর্নিশ চলে হরদম তস্‌লিম।'

কাজী নজরুল ইসলাম একাধিক কবিতা ও গান লিখেছেন ঈদের চাঁদকে কেন্দ্র করে। একটি বিখ্যাত গানের প্রথম কয়েকটি লাইন:

'ওরে ও নতুন ঈদের চাঁদ

তোমায় হেরে হৃদয় সাগর আনন্দে উন্মাদ ॥

তোমার রাঙা তশতরিতে ফিরদৌসের পরী

খুশির শিরনি বিলায় রে ভাই নিখিল ভুবন ভরি

খোদার রহম পড়ছে তোমার চাঁদনি রূপে ঝরি।

দুখ ও শোক সব ভুলিয়ে দিতে তুমি মায়ার ফাঁদ ॥'

শুধু ঈদের চাঁদ দেখার আনন্দ‌ই নয়, বরং ঈদের দিনে সালামির রেওয়াজ‌ও ছিল ব্রিটিশ আমলের বাংলায়। সাক্ষী হিসেবে পাওয়া যায় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও আবু রুশদের স্মৃতি। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লিখেছেন: 'আমার সেই শৈশব-বাল্যের ঈদের দিনের ছবি আঁকি। এর মধ্যে কাছে-পিছের থেকে, নানান ফ্ল্যাট থেকে আব্বার বন্ধু-বান্ধব, স্বজন, সহকর্মী সবাই এসে গেছেন; নিচের ব্যারাক থেকে এসেছেন হাবিলদার সেপাই এঁরা।...। বড়দের সালাম করবার পর তখনকার দিনেও ছিল সালামী উপহার দেওয়ার রেওয়াজ। এখন বেশ মজাই লাগে ভাবতে—পুলিশের নিচের পদের হাবিলদার সাবেরা সালামী দিতেন ডবল পয়সা। মাথায় মুকুট কুইন ভিক্টোরিয়ার অথবা সম্রাট পঞ্চম জর্জের ছাপ‌অলা তামার ডবল পয়সা। সেই যে কত ছিল!' (ইসলাম: ২০১৯, ২৬)

মুস্তাফা নূরউল ইসলামের বাবা চাকরি করতেন পুলিশে—ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ঈদের দিনে তাদের বাড়ির উৎসবমুখর পরিবেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে সামনে এনেছেন সালামি পাওয়ার বিপুল আনন্দের স্মৃতি। ব্রিটিশ আমলে সালামি হিসেবে ডবল পয়সা পাওয়ার আনন্দ যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে তার বর্ণনা থেকে। তখন যেমন ছিল 'মাথায় মুকুট কুইন ভিক্টোরিয়ার অথবা সম্রাট পঞ্চম জর্জের ছাপ‌অলা তামার ডবল পয়সা' পাওয়ার আনন্দ, এখন এই আনন্দ বিবর্তিত হয়েছে কচকচে নতুন নোট পাওয়াতে। এজন্যই রমজানের মধ্যেই ব্যাংকগুলোতে নতুন নোট পাওয়ার জন্য লম্বা লাইন পড়ে। বাজারে অনেককে দেখা যায় নতুন নোট নিয়ে ব্যবসা করতে। পরিবারের বড়জনরা এসব নতুন নোট সংগ্রহ করেন ঈদের পূর্বেই। সেই নোট ঈদের দিন যাবে বাড়ির ও প্রতিবেশী শিশু-কিশোরদের হাতে। আর সেই নতুন কচকচে নোট নিয়ে চোখেমুখে তাদের রাজ্যের আনন্দ!

এবার দেখবো কথাসাহিত্যিক আবু রুশদের কণ্ঠে সালামি পাওয়ার উচ্ছ্বাস: 'নামাজ শেষ করে খাওয়া দাওয়া সেরে ঈদের বক্‌শীস-এর আশায় আত্মীয়-মহলে আনাগোনা শুরু হয়ে যেতো। এক আনা, দু'আনা করে, এক বিশেষ আত্মীয়া একটা সিকিও দিতেন, আমার নসীবে এক টাকার উপর জুটে যেতো। আনা দিয়ে ট্রামের ফাস্ট ক্লাস ডেইজ কনশেসন টিকিট কিনে ট্রামে করে শহরটা চষে বেড়াতাম। বাগবাজার শ্যামবাজার নিমতলী কালীঘাট টালিগঞ্জ বালিগঞ্জ হ্যারিসন রোড বেলগাছি খিদিরপুর কলকাতার পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ কোনটাই আমার ঘুরবার আওতার বাইরে থাকতো না।' আহা, কিশোরকালের এমন মধুর স্মৃতিতে মুখরিত আমাদের সবার জীবন। ঈদের সালামি পাওয়ার পর এমন পাগলামি কিংবা আনন্দের বহিঃপ্রকাশ এখনো চলমান আমাদের সমাজে‌। সময়ের পরিক্রমায় সালামি আদান-প্রদান এখন ঈদের একটি অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উৎসব ক্রমশ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিয়োগ হয়, আবার কিছু জুড়ে বসে গায়ে। আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, ঈদের চাঁদ দেখার অন্যরকম আনন্দ কিংবা বড়দের সালাম করে সালামি গ্রহণের যে রেওয়াজ, তা দিনকে দিন বাড়ছে। শতবর্ষ পূর্বে যে রেওয়াজ ছিল গোটা কয়েক পরিবার কিংবা শহরে সীমিত, তা এখন প্রায় পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে গেছে। ঈদের চাঁদ দেখাকে কেন্দ্র করে আহ্লাদিত বালকের দল নেই এমন শহর বা গ্রাম বাংলায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঈদের দিন নামাজ শেষে সালাম করে সালামি গ্রহণের চিত্র পাওয়া যাবে না, এমন বাড়ি কল্পনা করাও অসম্ভব। বেদনার মতো আনন্দ‌ও সংক্রমিত হয় সবার মাঝে। আনন্দের ধারা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ঈদ উদযাপনে হয়তো সামনে আরও অনেক ধারা যুক্ত হবে। কিন্তু চাঁদ দেখা ও সালামি আদান-প্রদানের এমন চমৎকার রেওয়াজ চলতে থাকুক আমাদের মাঝে। আমাদের ঈদোৎসব হোক বহুমুখী রুচিশীল আনন্দের সমাহার।

Comments