যে কারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বিকল্প নয়

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত ভালো কাজই করুক না কেন, মানুষের চেয়ে বেশি সৃজনশীল হতে পারেনি
ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান সময়ে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে, অনেকের মনে তখন চাকরি হারানোর ভয় প্রবল হচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মানবশক্তি অগ্রাহ্য করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে এমনটা ভাবা ভুলই বটে। 

প্রযুক্তি বিষয়ক কাজগুলো একপাশে রাখলে দেখা যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেক কিছুর আওতার বাইরে থাকবে। 

সৃজনী শক্তি  

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত ভালো কাজই করুক না কেন, মানুষের চেয়ে বেশি সৃজনশীল হতে পারেনি। আর এটিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর মানুষের সক্ষমতার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রেখা টেনে দেয়। এ জন্য এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন কিছু চিন্তা করা এবং ভবিষ্যতে ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য সৃজনশীল কর্মীর সন্ধান করে। 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেক কাজের একক সমাধান হলেও, মানব মস্তিষ্কের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ভবিষ্যতে সফটওয়্যারের মাধ্যমে সৃজনীক্ষমতা সংযোজন করতে পারলে তা নিশ্চয়ই চমৎকার হবে, তবে সেটি পরিপূর্ণ মানুষের প্রতিস্থাপন করার পরিবর্তে মানুষের সহকারী হিসেবে কাজ করবে। 

জটিল চিন্তাশক্তি 

চারপাশে তথ্য-উপাত্তের কোনো কমতি নেই, কিন্তু সেগুলো যাচাই-বাছাই করে বিশ্বস্ত উৎস নির্বাচন করার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেই। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কর্মের যোগান দেওয়া সম্ভব হলেও, চিন্তার বিকল্প যোগানদাতা আবিষ্কার করা যায়নি। 

সর্বত্র যখন মিথ্যা, প্রতারণা ও গুজবের ছড়াছড়ি, তখন প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানই জটিলভাবে চিন্তা করে সঠিকতা খুঁজে বের করার জন্য দক্ষ কর্মী চায়, যারা তথ্যের গুণগত বিষয় যাচাই করে নির্ভুল উৎস বাছাই করার ক্ষমতা রাখে। জটিল চিন্তার দক্ষতা মানে কেবল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার পরিবর্তে বিশ্বস্ততাকে বোঝায়। আর এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে এখনো আশা করা যায় না।  

সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ করা গেলেও, কোনো তথ্য দিয়ে কী নির্দেশ করে তা বিচার করার ক্ষমতা কেবল মানুষেরই আছে। তথ্য বিবেচনা করে কোন সিদ্ধান্তের প্রভাব সমাজের প্রেক্ষাপটে সুফল বয়ে আনবে তা যন্ত্র বা সফটওয়্যার বুঝবে না। ঠিক একইভাবে, নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নৈতিকতার মানদন্ডে কতটুকু ইতিবাচক তা জানার জন্য মানুষের প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই।
 
সিদ্ধান্ত প্রায়ই জটিল হয়ে যায় বিধায় নির্দিষ্ট তথ্য দ্বারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ফলাফল বাতলে দিলেও, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন তথ্য যুক্ত করার ফলে পুনঃসিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা আছে কেবল মানুষের। 

আবেগিক বুদ্ধিমত্তা ও সহানুভূতি 

মানুষের আবেগ সচেতনতা, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রকাশ করার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে আলাদা বিশেষত্ব বহন করে। সামাজিক এবং মোবাইল প্রযুক্তি দ্রুত গ্রহণের ফলে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়কে ভিন্ন করেছে। যার ফলে ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি মানুষের আবেগিক বুদ্ধিমত্তা ও সহানুভূতি কমিয়ে দিচ্ছে। 

এই কারণেই মানসিক বা আবেগিক বুদ্ধিমত্তা (ইকিউ) দক্ষতার চাহিদা বাড়ছে। যতক্ষণ কর্মক্ষেত্রে মানুষ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আবেগিক বুদ্ধিমত্তা দক্ষতার মূল্যায়ন হবে, কারণ এটি মিথস্ক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।

সহযোগিতা ও দলগত কর্মদক্ষতা 

বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের সহযোগিতা ও দলগত কাজে পারদর্শিতার গুণাবলীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে। কেন না কর্মীরা দলগতভাবে কাজ না করতে পারলে যেমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হবে, তেমনি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। এ ছাড়া একে অপরের কাজে সহযোগিতার মনোভাব থাকলে সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা থাকে। 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দলগত কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে না, সহযোগিতা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিও সে ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে না। তাই এই বিষয়টিও কর্মক্ষেত্রে মানুষের প্রাধান্য জোরদার করবে। 

আন্তঃযোগাযোগ দক্ষতা

কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেকে নানা ধরনের আন্তঃযোগাযোগ দক্ষতার মাধ্যমে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, সম্মান প্রদর্শন করা, সঠিক অঙ্গভঙ্গি করা, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা, অনলাইন যোগাযোগ করা, উদারতা, প্রতিক্রিয়া দেওয়া ইত্যাদি প্রতিদিনকার রুটিনের কাজ।
 
ইদানীং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে শ্রবণ ও বাচনিক পারদর্শিতা প্রদর্শন করছে, তবে মানুষের ন্যায় কার্যকরী আন্তঃযোগাযোগে এটির বিচরণ নেই। 

গ্রহণযোগ্যতা ও নমনীয়তা 

সময়ের সঙ্গে প্রত্যেক মানুষকে নানা বিষয় শিখতে হয়, বর্জন করতে হয়। আজ যে কাজ ভালো ফলাফল এনে দিয়েছে, আগামীকাল তা একইরকম থাকবে তা বলা যায় না। এ অবস্থায় নতুন দক্ষতা অর্জন, পুরোনো দক্ষতা পরিহার বা নতুন-পুরাতনের মিশেলে ভিন্ন কিছুর আনয়নে মানিয়ে নিতে হয়। 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নতুন সংস্করণে আসার কম সময়ে মানুষ মানিয়ে নিতে পারে বিধায় কর্মক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণ অগ্রাহ্য করার যৌক্তিকতা নেই। 

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য 

কর্মক্ষেত্রে বিপুল কর্মীর সংযোগ হওয়ার পথ সহজ করতে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। আন্তর্জাতিক পরিসীমায় প্রতিষ্ঠানের সাফল্য ধরে রাখতে অন্য সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করতে হয়। দক্ষ কর্মী জাতি, লিঙ্গ, বয়স নির্বিশেষে ভিন্নভাবে যোগাযোগ করতে পারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নয়। 

নেতৃত্বদানে দক্ষতা

নেতৃত্ব কেবল প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গের গুণাবলি নির্দেশ করে না, কর্মক্ষেত্রে যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা দলগত কাজে নির্দেশনা দেয় প্রত্যেকের কাজই নেতৃত্বের আওতাভুক্ত। একজন নেতাই দলের প্রত্যেকের সেরা গুণ চিহ্নিত করতে পারে, দুর্বলতাকে সক্ষমতায় পরিণত করতে পারে। যেকোনো ক্ষেত্রে সফলতা পেতে হলে, যেসব বিষয় সুবিধা দিতে পারে তার মধ্যে এটি অন্যতম। কর্মী নেতৃত্ব দিতে পারলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে তা সম্ভব নয়।   

নৈতিক সচেতনতা

নৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় প্রায় প্রত্যেককে, যা দক্ষতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। মানুষ নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে যতটা সহজে এরূপ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তা করতে পারবে না। যার ফলে কর্মক্ষেত্রে মানুষের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। 

তথ্যসূত্র: ফোর্বস, এমইউও

গ্রন্থনা: আসরিফা সুলতানা রিয়া

 

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

1h ago