নতুন কালুরঘাট সেতু: প্রকল্প বাজেট ১২ গুণ বেড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা

ব্রিটিশ আমলে তৈরি কালুরঘাট সেতু। এই সেতুর স্থলে তৈরি হবে নতুন সেতু। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

চট্টগ্রামের কালুরঘাটে একটি নতুন রেল ও সড়ক সেতুর জন্য একাধিক সম্ভাব্যতা যাচাই এবং সেতুটির নকশা তৈরি ও বদল করতে ৯ বছর কাটিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ফলে, সেতুটি তৈরির জন্য প্রাথমিক অনুমানের প্রায় ১২ গুণ বেশি ব্যয় হতে যাচ্ছে।

২০১৪ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, ব্রিটিশ আমলের সিঙ্গেল লেন রেল ও সড়ক সেতুটি ব্যবহার না করে সেখানে নতুন সেতু নির্মাণের।

এর জন্য ২০১৮ সালে একটি সিঙ্গেল লেন রেললাইন ও ডাবল লেন সড়ক সেতুর জন্য বিশদ প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেই ডিপিপি অনুযায়ী, এই সেতুর জন্য ব্যয় হওয়ার কথা ছিল ১ হাজার ১৬৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

এখন, সেতুটিতে ডাবল লেন ডুয়েলগেজ রেললাইন ও ডাবল লেন সড়ক থাকবে। সেতুটির জন্য ব্যয় হবে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। গত মাসে দক্ষিণ কোরিয়া এই সেতুতে অর্থায়নের জন্য ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে।

নকশা পরিবর্তন ছাড়াও একাধিক সম্ভাব্যতা যাচাই, দেরি, নির্মাণ সামগ্রীর উচ্চমূল্য এবং কর্ণফুলীতে চলাচলকারী নৌযানগুলোকে  চলাচলের জায়গা দিতে সেতুর উচ্চতা বৃদ্ধিকে (ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স) ব্যয় বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হয়েছে।

নতুন সেতুটি নির্মাণ করতে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। তাই বাংলাদেশ রেলওয়েকে পুরনো সেতুটি মেরামতের খরচও বহন করতে হবে, যা ৫০ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে।

সেতুটি ব্যবহারের বিষয়ে সুপারিশ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দলকে নিয়োগ দিয়েছে। কারণ, এ বছরের শেষের দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে রেললাইন চালু হতে যাচ্ছে এবং এই সেতুটি এই রুটের একটি অংশ।

কর্ণফুলীর ওপর ১৯৩১ সালে নির্মিত সেতুটি বেশ অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। এটি ব্যবহারযোগ্য রাখতে নিয়মিত মেরামত করতে হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে এই সেতুতে প্রতি ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার বেড়ে ট্রেন চলাচল করতে পারে।

১৯৬২ সালে মিটারগেজ সিঙ্গেল লেন রেলসেতুটি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল, যেন এর ওপর দিয়ে অন্যান্য যানবাহনও চলাচল করতে পারে।

বোয়ালখালী উপজেলা, পটিয়ার পূর্ব ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ এবং চান্দগাঁও ও মহড়া এলাকার মানুষের জন্য নদী পারাপারে সেতুর কোনো বিকল্প নেই।

যেভাবে সিদ্ধান্ত

২০১৪ সালের এপ্রিলে সরকার দক্ষিণ কোরিয়ার সহযোগিতায় নতুন সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিলের (ইডিসিএফ) কাছে প্রযুক্তিগত সহায়তা চায় সরকার।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এই সেতুর জন্য দুই লেনের সড়ক এবং এক লেনের রেলসেতু নির্মাণের সুপারিশ করা হয়।

১ হাজার ১৬৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা আনুমানিক ব্যয়ের নতুন সেতুর জন্য ডিপিপি তৈরির ৪ মাস পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ রেলওয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, সেতুটিকে ডাবল লেনসহ একটি ডেডিকেটেড রেলসেতু করার।

২০১৯ সালে আরেকটি সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হলেও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ, কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে যে ২০১৮ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলীকে একটি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে রেখেছে, যার ফলে নৌযান চলাচলের জন্য সেতুর উচ্চতা আরও বাড়াতে হবে।

এর মধ্যেই নকশা তৈরি নিয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

ইডিসিএফের তহবিলে আরেকটি সম্ভাব্যতা যাচাই হয় ২০২১ সালে। সেই অনুযায়ী, এখানে একটি দ্বিতল সেতু নির্মাণের সুপারিশ করা হয়, যার উপরের তলায় থাকবে ডবল লেনের সড়ক এবং নীচে থাকবে ডুয়েলগেজ ডাবল লেনের রেললাইন।

সূত্র জানায়, ২০২২ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নির্দেশ দেয়, সেতুটিতে ডাবল লেন ডুয়েলগেজ রেললাইন ও ডাবল লেনের সড়ক হবে। তবে সেতুটি দ্বিতল নয়, একতলা বিশিষ্ট হবে।

খরচ বেড়েছে ১২ গুণ

ইউশিন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন এবং দোহওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং যৌথ উদ্যোগে এ বছরের শুরুতে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করেছে এবং অনুমান করেছে যে, প্রকল্পের ব্যয় হবে ১ হাজার ৩৪২ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ডলার বা ১৩ হাজার ৮২৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা (প্রতি ডলারে ১০৩ টাকা বিনিময় মূল্য ধরে)।

এর জন্য ৭১২ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলার বা ৭ হাজার ৩৩৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা কোরিয়ান ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং বাকিটা সরকার অর্থায়ন করবে।

বর্তমান টাকা ও ডলারের বিনিময় হার ১০৭ টাকা বিবেচনায় নিলে খরচ দাঁড়াবে ১৪ হাজার ৩৬২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নকশা পরিবর্তনের পর খরচ বেড়েছে ২৫০ কোটি টাকা।

খরচ বৃদ্ধি

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে যখন ডিপিপি তৈরি করা হয়, তখন প্রস্তাবিত সেতুর দৈর্ঘ্য ছিল ৩ কিলোমিটার, যার মধ্যে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ১ কিলোমিটার এবং বেড়িবাঁধের ২ কিলোমিটার। নৌযান চলাচলের জন্য ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স ছিল ৭ দশমিক ৬২ মিটার।

নৌযান চলাচলের জন্য এখন ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স রাখতে হবে অন্তত ১২ দশমিক ২ মিটার। এর ফলে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার। ১ কিলোমিটার মূল সেতুর পাশাপাশি উভয় পাশে ৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও উভয় পাশে ৫ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার বাঁধ তৈরি হবে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'এটাই ব্যয় বৃদ্ধির একটি বড় কারণ।'

তিনি জানান, বেশি ধারণক্ষমতাসহ একটি বড় সেতু করার সিদ্ধান্ত এবং নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেও সেতুর সম্ভাব্য ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে।

গতকাল রোববার যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খরচ এত বেশি হওয়ার কথা না। আমি তথ্য জেনে তারপর মন্তব্য করতে পারব।'

Comments