জসীমউদ্দীনের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ

জসীমউদ্দীনের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ
ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভাষা আন্দোলনের চেতনারই সম্প্রসারিত রূপ। ভাষা আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মৌলিক পার্থক্য বা ব্যবধান হলো পৃথক রাষ্ট্রগঠনের প্রত্যয়। এজন্য দেশভাগোত্তর পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষদের যে পরিমাণ মূল্য দিতে হয়েছে, তা বিশ্বের খুব কম সংখ্যক জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একাত্তরে হত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচারের যে ভয়াল, বীভৎস ও নারকীয়তা এদেশীয় সর্বস্তরের মানুষের ওপর নেমে আসে, তা বর্ণনাতীত।

মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর সেই বিবর্ণ ও বৈরী জীবনবাস্তবতার রূপনির্মাণ বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিক বহুবিধ ও বহুরৈখিকভাবে করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পঞ্চাশোত্তর বছর পরও এই প্রয়াস গতিশীল। সমগ্র বাঙালি জীবনের অবিস্মরণীয় আত্মাহুতি ও অর্জনের বিচিত্র অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা সময়ের দূরত্বে অবস্থান করে কবিকল্পনায় নির্মাণ-বিনির্মাণ করা সহজ না হলেও জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে তা সহজই। মুক্তিযুদ্ধে জীবনকে বাজি রেখে শত্রুপক্ষের বর্বরতা আর নতুন রাষ্ট্রাকাঙ্ক্ষার প্রত্যয় ও চৈতন্যের প্রত্যক্ষ শিল্পরূপ নির্মাণ কঠিন। আর কঠিনতম শিল্পকর্মে সাহসী ভূমিকা রাখা কবিদের মধ্যে অগ্রজ হলেন জসীমউদ্দীন।

একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলোতে জসীমউদ্দীন স্বদেশে অবস্থান করে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত রক্তে স্নাত দেশের জন্য কবিতা লিখেছেন। কবিতা তখন তার কাছে যুদ্ধাস্ত্র। তখন তার কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন শত্রুর বিরুদ্ধে ছোড়া বুলেটের সমান। তখন তার কবিতার প্রতিটি পঙক্তি যেন বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব-জনমত তৈরির দুর্বার ও দুর্মদ প্রক্রিয়া। জসীমউদ্দীন মূলত জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধরত জাতির প্রতি বিশ্ববিবেকের সহানুভূতি সৃষ্টি এবং স্বর্গ-ম্রিয়মাণ সমৃদ্ধ স্বদেশচেতনার স্বপ্ন বুনন করেছেন তার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতায়। কবিতাগুলো তুজম্বর আলি ছদ্মনামে পাঠিয়েছিলেন ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকায়। অনূদিত হয়ে অনেক কবিতাও ছাপা হয়েছিলো তখন আমেরিকা ও রাশিয়ায়। যে-কারণে মুক্তিযুদ্ধে জসীমউদ্দীনের কবিতা শুধু শিল্পমাধ্যম নয়, কাব্যচর্চার চেয়ে বড় কিছু। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত জসীমউদ্দীনের সেই কবিতাগুলোর মূল্য ঐতিহাসিক।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত জসীমউদ্দীনের প্রথম কবিতা 'বঙ্গ-বন্ধু'। রচনাকাল ১৬ মার্চ ১৯৭১। বস্তুত, ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু ও বাঙলাদেশ যে মিলেমিশে একাকার, শেখ মুজিবুর রহমান যে হাজার বছরের বাঙালির আর্থরাজনৈতিক মুক্তির দূত হিসেবে আসীন, তিনি যে বাঙালির মুকুটহীন প্রমূর্ত মহারাজ, তা কবিকে করেছে আশাবাদী ও চেতনাদীপ্ত। কবির এই চেতনার কাব্যস্ফুলিঙ্গ 'বঙ্গ-বন্ধু'; যা ঐক্য, অঙ্গীকার আর গৌরবে সমুন্নত:

মুজিবুর রহমান

ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।

বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে

জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞ্ঝা-অশনি বেয়ে।

বিগত দিনের যত অন্যায় অবিচার ভরা-মার,

হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যের অঙ্গার;

দিনে দিনে হয়ে বর্ধিত স্ফীত শত মজলুম বুকে,

দগ্ধিত হয়ে শত লেলিহান ছিল প্রকাশের মুখে;

তাহাই যেন বা প্রমূর্ত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি

ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি।

২৭ মার্চ কবি বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে রচনা করেন 'কবির নিবেদন'; যেখানে পাশবিকতায় নরঘাতী ইয়াহিয়া বিবেচিত হয়েছে তৈমুর লং ও নাদির শাহের চেয়েও জঘন্য ও ভয়াবহ:

প্লাবনের চেয়ে—মারিভয় চেয়ে শতগুণ ভয়াবহ,

নরঘাতীদের লেলিয়ে দিতেছে ইয়াহিয়া অহরহ।

প্রতিদিন এরা নরহত্যার যে-কাহিনী এঁকে যায়,

তৈমুরলং নাদির যা দেখে শিহরিত লজ্জায়।

এ-কবিতায় বিশ্ববিবেক ও মানবতার জাগরণ আর আহ্বানে কবির আকুতি: 'দেশ-দেশান্তে দয়াধর্মের শপথ মানবতার/ তোমরা আসিয়া ভাঙ এ নিষ্ঠুর এজিদের কারাগার।' ২৯শে মার্চ 'তোমার কবিতা'য় কবি দেখালেন পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর ভয়াল নৃশংসতা ও মনুষ্যত্বের ব্যাঘ্ররূপী বিকৃতরূপ: 'বনের বাঘে যে খায় না মানুষ, মানুষে মানুষ খায়/ মানুষের ভয়ে বনে সে লুকাবে সেথায় মানুষ ধায়।' এ কোন মানুষ?

এই বর্বর অমানুষদের নিধনযজ্ঞের বর্ণনায় ২৭ এপ্রিল 'কি কহিব আর' শীর্ষক কবিতায় কবির অভিব্যক্তি: 'সেথাও তাদের নাহি নিষ্কৃতি, বন হতে খুঁজে আনি/ পিঁপড়ের মতো মারিছে মানুষ বুলেটে আঘাত হানি।' পশ্চিমাদের এই পৈশাচিক তাণ্ডবে অসহায় ও অতিষ্ঠ কবি ২৯ এপ্রিল রচনা করেন 'খবর' কবিতা; যেখানে জালিমের হুঙ্কার, আগুনের ফুঁৎকার আর আহতের চিৎকারের রূপবন্ধে উচ্চারিত হয়েছে কবির মর্মবেদনা:

মায়া মরিয়াছে, দয়া মরিয়াছে, মরিয়াছে মানবতা,

আওলা বাতাসে আছাড়ি পিছাড়ি কাঁদে বসুমতী মাতা।

এই ক্রন্দন আর কোনোখানে আর কোনো দেশে হায়,

পসিয়া কি কভু জাগায়ে তুলিবে মৃত এ মানবতায়!

২ মে রচিত 'দগ্ধগ্রাম' কবিতায় মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে পশ্চিমা নরঘাতদের অট্টহাসি আর ধ্বংসযজ্ঞ, হৃদয়বিদারী ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের নিদারুণ চিত্র:

কিসে কী হইল, পশ্চিম হতে নরঘাতকেরা আসি,

সারা গাঁও ভরি আগুন জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।

মার কোল হতে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল সে খান খান,

পিতার সামনে মেয়েরে কাটিয়া করিল রক্ত-স্নান।                                       

হিন্দু-সম্প্রদায়ের প্রতি একাত্মতা, পাকিস্তানী দোসরদের প্রতি ঘৃণা এবং ধর্মীয় ভণ্ডামির প্রতি কবির প্রতিবাদী সত্তার পরিচয় মেলে ১৬ মে রচিত 'ধামরাই রথ' কবিতায় : 'পাকিস্তানের রক্ষাকারীরা পড়িয়া নীতির বেশ/ এই রথখানি আগুনে পোড়ায়ে করিল ভস্মশেষ।/ শিল্পী-হাতের মহা সান্ত্বনা যুগের যুগের তরে/ একটি নিমেষে শেষ করে গেল এসে কোন বর্বরে।' ৫ জানুয়ারি রচিত 'গীতারা চলিয়া যাবে' কবিতায় মূর্ত হয়েছে হিন্দু-সম্প্রদায়ের দেশছাড়া হবার হার্দিক হাহাকার : 'গীতারা চলিয়া যাবে হলদে পাখিটি ছাড়িবে রাজার দেশ/ কোথা উড়ে যাবে কোনো দূর দেশে কে করিবে সন্দেশ।'

জসীমউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে স্বদেশমাতার নির্ভয় ছেলে হয়ে দস্যুবিহীন দেশ গড়ার প্রত্যয়ে হয়েছিলেন সদাজাগ্রত ও বিভোর। কবি নন, সেদিন তিনি নিজেকে মনে করেছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার দেশ গড়ার প্রত্যয়ে ৬ই জুলাই তিনি রচনা করেন 'মুক্তি-যোদ্ধা' কবিতা; যেখানে তিনি নির্ভয়, চির-নির্ভীক:

আমি একজন মুক্তি-যোদ্ধা, মৃত্যু পিছনে আগে,

ভয়াল বিশাল নখর মেলিয়া দিবস রজনী জাগে।

কখনো সে ধরে রাজাকার বেশ, কখনো সে খানসেনা,

কখনো সে ধরে ধর্ম লেবাস পশ্চিম হতে কেনা।

সময়ের সাহসী সন্তান মুক্তিযোদ্ধারূপী কবির দীপ্ত শপথ: 'এ সোনার দেশে যতদিন রবে একটিও খান-সেনা/ ততদিন তক মোদের যাত্রা মুহূর্তে থামিবে না।' কিন্তু, যুদ্ধই তো শেষকথা নয়, যুদ্ধ তো একদিন সমাপ্ত হবে, তখন কবি কোন স্বদেশকে দেখতে চান? কবির স্বপ্নে, তাঁর চেতনায় কেমন-কীরূপ স্বদেশভূমি জাগরূক, তার একটি চিত্রকল্প অঙ্কিত হয় একই কবিতায়:

মাঠগুলি পুনঃ ফসলে ফসলে পরিবে রঙিন বেশ,

লক্ষ্মীর ঝাঁপি গড়ায়ে ছড়ায়ে ভরিবে সকল দেশ।

শুধু 'মুক্তি-যোদ্ধা' কবিতায় নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত জসীমউদ্দীনের প্রথম কবিতা 'বঙ্গ-বন্ধু'তেও কবির এই কাঙ্ক্ষিত স্বদেশের ছবি পাওয়া যায়:

আরও একদিন ধন্য হইব, ধন-ধান্যতে ভরা,

জ্ঞানে-গরিমায় হাসিবে এদেশ সীমিত-বসুন্ধরা।

মাঠের পাত্রে ফসলেরা আসি ঋতুর বসনে শোভি,

বরনে সুবাসে আঁকিয়া যাইবে নকশী-কাঁথার ছবি।

মানুষে মানুষে রহিবে না ভেদ, সকলে সকলকার,

একসাথে ভাগ করিয়া খাইবে সম্পদ যত মার।

পদ্মা মেঘনা যমুনা নদীর রূপালির তার পরে,

পরান-ভুলানো ভাটিয়ালী সুর বাজিবে বিশ্বভরে!

গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও প্রাণপ্রাচুর্যকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তুলে আনার দক্ষতায় জসীমউদ্দীনের জুড়ি নেই! রাখালী, নক্সীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ইত্যাদি তার অনন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু, একাত্তরে দেশমাতৃকার বস্ত্রহরণে কবি যে কতোটা বিচলিত, আবেগী ও সোচ্চার ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে নামক কাব্যগ্রন্থে। আটষট্টি বছর বয়সে উপনীত কবির কাছে তখন আর শিল্প-শৈলী নয়, মুখ্য হয়ে উঠেছিলো যুদ্ধ-বিধ্বস্ত স্বদেশের বিপর্যস্ত মুখ। কবি সে-মুখ অঙ্কনে যে সাহসী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছেন, তা প্রেরণা দিবে প্রজন্মকে।

Comments

The Daily Star  | English

BNP struggles to rein in the rogues

Over the past 11 months, 349 incidents of political violence took place across the country, BNP and its affiliated organisations were linked to 323 of these

9h ago