একটি মডেল নির্বাচন

জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যা ঘটল, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের একটি ঐতিহ্য ছিল। আইনজীবীরা জাতীয় রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত থাকেন এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ অতীতের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এই আইনজীবীদের মধ্য থেকে জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ এসেছেন।

আওয়ামী লীগপন্থী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মতাদর্শগত বিরোধ থাকে, নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা থাকে, কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় সর্বমহলে। এবারের নির্বাচনে কি ঘটল, ঐতিহ্যের পরিণতিই বা কি হলো?

নিয়ম-নীতি অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটি গঠন করা হয়। সদস্য ৬ জনের মধ্যে ৩ জন আওয়ামীপন্থী ও ৩ জন বিএনপিপন্থী আইনজীবী। ২ পক্ষের সম্মতিতে এই কমিটি গঠন করা হয়।

উল্লেখ্য, আহ্বায়ক মনসুরুল হক আওয়ামীপন্থী আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি। তিনি আওয়ামীপন্থী প্যানেল থেকে ইতোপূর্বে ২ বার নির্বাচনও করেছেন। কিন্তু তার এই রাজনৈতিক পরিচিতি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনে কোনো বাধা হয়নি। বলা হয়ে থাকে, সমাজে নিরপেক্ষ বা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য কোনো মানুষ নেই। সেখানে মনসুরুল হক চৌধুরী সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী চরিত্র হিসেবে সামনে আসেন। সুপ্রিম কোর্টের আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের কাছে তো গ্রহণযোগ্য ছিলেনই, বিএনপিপন্থী আইনজীবীরাও তার রাজনৈতিক পরিচিতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। উল্টো সম্পূর্ণ আস্থা রেখেছেন তার ওপর। বর্তমান বাংলাদেশে যা প্রায় বিরল ঘটনা।

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছিল, ততই আওয়ামী লীগপন্থী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও উত্তেজনা দৃশ্যমান হচ্ছিল। নির্বাচন পরিচালনা ও ব্যালট পেপার ছাপানো এবং ভোট গণনা পদ্ধতি নিয়ে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে মতপার্থক্য দেখা দেয় মনসুরুল হক চৌধুরীর। অভিযোগ আছে, আওয়ামীপন্থী আইনজীবী নেতারা প্রকাশ্যেই তাকে 'বায়াসড' বলেন, অসম্মান করেন।

মনসুরুল হক চৌধুরী ভোট গণনা করতে চাইছিলেন ইসিএমে (ইলেকট্রিক কাউন্ট মেশিন)। ব্যালট পেপার ছাপতে চাইছিলেন তার নিজ দায়িত্বে। আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের দাবি, ভোট গণনা করতে হবে হাতে এবং ব্যালট পেপার ছাপাবে কার্যকরী কমিটির সদস্যরা।

এমন মতবিরোধের এক পর্যায়ে নির্বাচনের আগের দিন হঠাৎ করে তিনি পদত্যাগ করেন। সংকট শুরু এখান থেকেই। বদলে যায় নির্বাচনের পরিবেশ।

নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. মনিরুজ্জামানকে। বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের অভিযোগ, নিয়ম অনুযায়ী উভয়পক্ষ বসে সদস্যদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে আহ্বায়কের দায়িত্ব দিতে হবে। তা না করে আওয়ামীপন্থীরা এককভাবে সিনিয়রদের বাদ দিয়ে জুনিয়র মো. মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করেন। তাকে আহ্বায়ক হিসেবে মেনে নেয় না বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।

আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের দাবি, নিয়ম ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই নতুন আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয়েছিল। বিএনপিপন্থীরা নির্বাচনকে বিতর্কিত করার জন্যে এসব অভিযোগ করছেন।

বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা অভিযোগ করেন, তারা নিজেরা ব্যালট পেপার ছাপিয়েছে। কমিটিতে থাকা আমাদের ৩ জন সদস্যকে কিছুই জানায়নি। ১ হাজার ব্যালট পেপার বেশি ছাপানো হয়েছিল এবং নির্বাচনের আগে রাত ১০টার দিকে ব্যালট পেপারে সিল মারছিল আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা। সিল মারার সময়ই বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা সেখানে হাজির হন, তৈরি হয় হট্টগোল।

আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের বক্তব্য, সিল মারা হচ্ছিল না। ব্যালট পেপারে আহ্বায়ক সই করছিলেন। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ব্যালট পেপার ছিনতাই করে, ছিঁড়ে ফেলে। মামলা করা হয় বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের নামে।

সকাল ১০টা থেকে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি নেয় আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা। বাধা দেয় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। কয়েক দফা ধাক্কাধাক্কি চলে। ভোট গ্রহণ শুরু করা যায় না। সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ এসে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের। তারা নির্বাচনের স্থান থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরপর পুলিশ কিল-ঘুষি-লাথিসহ পেটাতে শুরু করেন সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া সাংবাদিকদের।

তর্কের খাতিরে, বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের পেটানোর একটা যুক্তি এভাবে দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে যে, তারা নির্বাচনে বাধা দিচ্ছিলেন। যদিও এই যুক্তি দিয়ে পেটানোর কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সাংবাদিকদের কেন পেটানো হলো? তারা তো আইনজীবীদের পেটানোর সময় পুলিশকে বাধা দেয়নি, বাধা দেয়নি নির্বাচনেও। তাহলে সাংবাদিকদের অপরাধ কী ছিল?

অপরাধ ছিল, যা ঘটছিল তা তারা দেখছিলেন, ক্যামেরায় ধারণ করছিলেন। বিনা কারণে আইনজীবীদের পেটানোর দৃশ্য তারা ক্যামেরায় ধারণ করছিলেন। নির্বাচনের ভোটগ্রহণসহ কোনো কিছু যাতে সাংবাদিকরা না দেখেন, ক্যামেরায় ধারণ করতে না পারেন, সেকারণে তাদের পিটিয়ে বের করে দেওয়া হয়।

এই দায় কার? কারা পুলিশ ডেকে আনলেন?

প্রধান বিচারপতি বিএনপিপন্থী আইনজীবী নেতাদের বলেছেন, তিনি পুলিশ ডাকেননি বা পুলিশ আসার অনুমতি দেননি। গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না ডেইলি স্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নিয়ম না থাকলেও এটাই প্রচলিত রীতি যে প্রধান বিচারপতির অনুমতি ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে পুলিশ ঢুকতে পারে না।

কিন্তু পুলিশ ডাকার দায়-দায়িত্ব কেউই নিচ্ছিলেন না। একটি মামলা থেকে বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট হলো।

এই ঘটনায় শাহবাগ থানায় দায়ের করা পুলিশের মামলা থেকে জানা যায়, আওয়ামীপন্থী আইনজীবী প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী মো. মমতাজ উদ্দিন ফকির ও সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুর নূর দুলাল পুলিশের সহযোগিতা কামনা করেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। পুলিশের মামলার নথিতে যা উল্লেখ করা হয়েছে।

পুলিশের মামলার নথিতে লেখা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের সকল সদস্য ও সাধারণ আইনজীবীরাও পুলিশের সহায়তা চেয়েছেন। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বলেছেন, নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে থাকা তাদের ৩ সদস্য পুলিশের সহযোগিতা চাননি। তারা আরও বলছেন, প্রধান বিচারপতি ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে কারো পুলিশ ডাকার এখতিয়ার নেই। পুলিশ ডাকার বিষয়টি আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা এখন স্বীকারও করতে চাইছেন না।

ঘটনা পরিক্রমা বিশ্লেষণ করলে পরিস্কারভাবেই বোঝা যায় যে, আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরাই পুলিশ ডেকেছেন। পুলিশের করা মামলায় তা লেখা হয়েছে। কিন্তু বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও সাংবাদিকদের পেটানোর নির্দেশ কে দিলেন? যারা ডেকেছেন, তারাই? যারা পুলিশ ডেকে এনেছেন, তারা কি এই দায় এড়াতে পারেন?

সাংবাদিকদেরও পিটিয়ে বের করে দিয়ে ভোটগ্রহণ শুরু করতে হলো কেন? নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তো সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে উপস্থিতি প্রত্যাশা করার কথা।

সামগ্রিকভাবে ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে কিছু গুরুতর প্রশ্ন সামনে আসে।

ক. মনসুরুল হক চৌধুরীকে অপমান-অসম্মান বা চাপ দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।

খ. পুনরায় আহ্বায়কের দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে, তা নিয়ে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। সিনিয়রদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক জুনিয়র নিজ দলীয় একজনকে এককভাবে দায়িত্ব দিয়েছেন।

গ. ছাপানো ব্যালট পেপারে আহ্বায়ক হিসেবে নাম ছিল মনসুরুল হক চৌধুরীর। নির্বাচনের আগের রাতে মনসুরুল হক চৌধুরীর নাম কেটে আহ্বায়ক মনিরুজ্জামানের নামে সিল মারা হচ্ছিল এবং তিনি সই করছিলেন। বিএনপিপন্থীরা যেটাকে বলছে, সিল-সইয়ের সঙ্গে ভোটও দিয়ে রাখা হচ্ছিল। সত্য যাইহোক, সিল-সইয়ের প্রক্রিয়াটি ছিল সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ। যার ফলে বিএনপিপন্থীদের অভিযোগ ভিত্তি পেয়ে যায়।

ঘ. আওয়ামীপন্থী আইনজীবী নেতা মমতাজুদ্দিন ফকির ও আবদুর নূর দুলাল পুলিশ ডেকে এনেছেন। প্রধান বিচারপতি পুলিশ ডাকেননি বা পুলিশ ডাকার আগে তার সম্মতি নেওয়া হয়নি বা তার সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি।

ঙ. পুলিশ এসে বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও সাংবাদিকদের পিটিয়ে অডিটোরিয়াম থেকে বের করে দেওয়া বিষয়ে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের 'দেখিনি', 'শুনিনি', 'ঠিক করেনি', 'যদি পিটিয়ে থাকে' জাতীয় বক্তব্য বা প্রতিক্রিয়া বড় রকমের প্রশ্নবিদ্ধ।

বিএনপিপন্থীদের অভিযোগ কতটা সত্যি, সেই বিতর্কের বাইরে এসেও যে প্রশ্নটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ তা হলো—কি দৃষ্টান্ত তৈরি হলো?

ভোটগ্রহণ করতে হলো একপক্ষ ও সাংবাদিকদের পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে  বের করে দিয়ে। যুক্তি দেওয়া যেতে পারে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন মেলানো ঠিক হবে না। এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাও হয়ত বলবেন কেউ কেউ?

আসলে কি তাই? কোনো কিছুই কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এই প্রশ্নের উত্তরে 'হ্যাঁ' বলা মানুষের সংখ্যা খুব বেশি পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

জাতীয় নির্বাচনের আগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাচন যদি একটি মডেল হয়, তবে জাতীয় নির্বাচনটি কেমন হতে পারে?

mortoza@thedailystar.net

Comments

The Daily Star  | English

Local mechanics rev up the road, now govt needs to catch up

Amid the worldwide development of electric vehicles, which is changing the traffic landscape away from fossil fuels, Bangladeshi mechanics brought their humble version of an e-vehicle to the road: a battery-run rickshaw -- awkwardly wired, with visible battery units slinging on the back.

12h ago