শোক করমু নাকি মামলা করমু-'বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত বৃদ্ধের পুত্রবধূর প্রশ্ন

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে র‌্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত আবুল কাশেমের স্বজনদের শোক। ছবি: স্টার

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে র‌্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' আবুল কাশেম নামে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন। হত্যা মামলার আসামি গ্রেপ্তারে র‌্যাবের অভিযানের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। এই ঘটনার পর আবার অভিযান চালিয়ে ২ কিশোরসহ ২০ জনকে আটক করে র‍্যাব। তাদের মধ্যে ১৫ জনকে ১৮ ঘণ্টা হেফাজতে রাখার পর শনিবার সন্ধ্যায় ছাড়ে র‍্যাব।

শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের বরগাঁ এলাকায় এই ঘটনার পর থেকে উৎকণ্ঠায় আছেন গ্রেপ্তারকৃতদের পরিবারের সদস্যরা। র‍্যাব হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া ব্যক্তি ও স্বজনরা রোববার সকালে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'র‍্যাবের ওপর হামলায় তারা জড়িত নন৷ গ্রামে ডাকাত পড়েছে শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন৷ ওই সময় গুলি চলে৷ এর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর র‍্যাব এসে বিনা কারণে তাদেরকে ধরে নিয়ে যায়৷'

প্রায় ১৮ ঘণ্টা র‍্যাব হেফাজতে থাকার পর শনিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের জিম্মায় ছাড়া হয় ১৫ জনকে৷ র‍্যাবের ওপর হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বাকি ৫ জনকে৷

গ্রেপ্তার দেখানোদের মধ্যে নিহত আবুল কাশেমের ছেলে নজরুল ইসলাম ও তার তিন ভাতিজা ও এক নাতি রয়েছেন৷

নিহতের পুত্রবধূ আমিনা বলেন, 'শ্বশুর গুলিতে মারা গেল৷ স্বামী গ্রেপ্তার হইয়া আছে৷ বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নাই৷ তারাও গ্রেপ্তারের ভয়ে পালাইয়া আছে৷ এখন মরার শোক করমু নাকি মামলা করমু কিছুই বুঝতে পারতেছি না৷ মামলা করলেই বা কার নামে করমু? পুলিশ কি আমাগো মামলা নিবো?'

ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে এসেছেন আবুল কাশেমের বোন মিনারা বেগম৷ তিনি বলেন, 'মরছি আমরা মরছি৷ আমরা তো তাগো লগে পারমু না৷ তারা আইনের লোক৷ তাগো বিরুদ্ধে কেমনে মামলা করমু?'

নিহত আবুল কাশেমের বাড়ির পাশেই জামদানি কারিগর নূর হোসেনের বাড়ি৷ র‍্যাবের হেফাজত থেকে ফিরে এসে নূর হোসেন বলেন, 'ডাকাত পড়ছে শুইনা ঘুম থেকে উঠি৷ পরে জানতে পারি পাশের বাড়ির কাশেম চাচা গুলিতে মারা গেছেন৷ পরে আবার বাসায় আইসা শুইয়া পড়ি৷ এর দেড়-দুই ঘণ্টা পর র‍্যাব আবারও আসে৷ পরে অনেকরে ধইরা নেয়৷ অনেকরে মারধরও করে তখন৷ এগুলা দেইখা আমি আর নড়াচড়া করি নাই৷ পরে আমারেও ধইরা নেয়৷'

তিনি বলেন, 'আমাগো ভোর পর্যন্ত গ্রামের পাশে একটি বালুর মাঠে রাখছিল৷ পরে আদমজীতে র‍্যাব-১১ এর ক্যাম্পে নেয়৷ ওইখানে আমাগো ২০ জনরে একলগে একটা হাজতের মইধ্যে রাখে৷ আমাগোরে ৭-৮ জন একেকবার আইসা জেরা করে৷ বক্তব্য ভিডিও করে৷ এরপর সন্ধ্যার দিকে এলাকার সাবেক এমপি (আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত) ও আওয়ামী লীগের নেতাগো জিম্মায় আমাদের ছাড়ে৷ তাগো দুইটা গাড়িতেই আমরা ১৫ জন আসি৷ কাশেম চাচার পোলাসহ পাঁচজনকে ছাড়ে নাই৷'

নূর হোসেন বলেন, 'কখনও জেলে যাই নাই৷ আমরা কামের মানুষ৷ কাম না করতে ভাত হয় না৷ র‍্যাব ধরায় ভয় পাইছি৷'

নূর হোসেনের স্ত্রী রুবিনা বলেন, 'আমার স্বামীরে অন্যায়ভাবে ধরে নিছিল৷ হ্যায় তো কোনো অপরাধ করে নাই৷ সারাক্ষণ চিন্তা করছি, আত্মীয়-স্বজনেরে কল দিছি৷ কোনো কারণ ছাড়াই রাইত-বেরাইতে ধইরা নেওয়া, এইটা গরিব মানুষের লগে অন্যায়৷'

র‍্যাব ওই রাতে হেফাজতে নিয়েছিল ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরকেও৷ তার মা বলেন, 'প্রতিটা সেকেন্ড কষ্টে কাটছে৷ একজন মানুষ মাইরা ফেলছে৷ পোলাডারে কী করে না করে তার ঠিক নাই৷ আমি গরিব মানুষ, আগে-পরে কিছু নাই৷ আমার পোলাডারে নেওয়ায় সারাক্ষণ চিন্তায় ছিলাম৷ আমার পোলাডায় যে ফিরা আইছে এইডায় আলহামদুলিল্লাহ৷'

তিন সন্তানের মধ্যে তার এই ছেলে বড়৷ সে কাঁচপুরে নানার বাড়িতে থেকে জামদানি তৈরির কাজ শেখে৷ প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার বাড়িতে আসে, একটা দিন বাবা-মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে আবার চলে যায়৷

তারা মা আরও বলেন, 'সপ্তাহে একটা দিন বাড়িত আহে পোলাডায়৷ কপালের শনি ওইরাতেই হইছে৷ পোলাডারে নেওয়ার সময় পায়ে র‍্যাব দুইটা বাড়ি মারছে লাঠি দিয়া৷ ফেরার পর রাতে ব্যথার ওষুধ খাওয়াইছি৷ কি না কি ঝামেলা হয়— নানার বাড়িত পাঠাইয়া দিছি৷'

র‍্যাবের হেফাজতে ছিল দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী৷ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত আবুল কাশেম সম্পর্কে তার দাদা হন৷ শনিবার সন্ধ্যায় সে র‍্যাব হেফাজত থেকে মুক্ত হলেও তার বাবাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে৷

তার মা বলেন, 'আমার ছেলে ফিরছে শনিবার সন্ধ্যায়৷ বাবার সঙ্গে ওরেও ধরে নিয়া গেছিল৷ ধরে নেবার সময় ৪-৫টা বাড়ি দেয়৷ রানটা ফুইল্লা কালা হইয়া আছে৷ ওরে খালার বাড়িত পাঠাইয়া দিছি৷'

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

2h ago