এবার গণমাধ্যমকেও নতুন করে বুঝে নিচ্ছেন হাথুরুসিংহে
প্রথম দফায় দারুণ কিছু সাফল্যের সঙ্গে অনেক বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছিলেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে কেবল একটা সিরিজ পার করলেন। এখনই হয়ত তার সম্পর্কে মন্তব্য করা কঠিন। তবে স্বল্প সময়েও নিজের প্রবল উপস্থিতির জানান ঠিকই দিচ্ছেন এই লঙ্কান কোচ।
প্রথম দিন সংবাদ সম্মেলনে এসে প্রশ্নকারী সাংবাদিকদের নাম ও প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে চেয়েছিলেন। সেই ধারা অব্যাহত আছে এখনো। যারা অল্প চেনা কিংবা অচেনা তারা তো বটেই। যাদের আগে থেকে চিনতেন তাদেরও বুঝে নিতে চাইছেন নতুন করে। কে কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ধরণের প্রশ্ন করছেন এই ব্যাপারে গভীর মনোযোগ দিচ্ছেন তিনি। কার প্রশ্নে মন্তব্য আছে, কার প্রশ্নে বিতর্কিত বিষয় আছে তা হিসেব করে উত্তর দিতে খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আসছেন, পরিস্থিতি সামালও দিচ্ছেন সেভাবে।
বাংলাদেশে আগের দফাতেই বুঝেছেন এদেশের ক্রিকেটীয় সংস্কৃতির বাস্তবতায় গণমাধ্যমের বড় একটা প্রভাব আছে। এবার এসে টের পাচ্ছেন এই প্রভাব হয়ত আরেকটু বেড়েছে, কিন্তু শৃঙ্খলা আসেনি সেভাবে। বিভিন্ন ইস্যুতে হাওয়া গরম হয়ে এখানে লেজেগোবরে অবস্থা হয় প্রায়ই। হাথুরুসিংহে এমনটা খুব ভালো করে বুঝে নিয়ে যেন বাড়তি সতর্ক।
কোথায় কি লেখা হচ্ছে বা বলা হচ্ছে নিবিড়ভাবে খোঁজ রাখছেন তিনি। ইংরেজি হলে তো নিজেই পড়ে নেন। বাংলা প্রতিবেদনও কারো সাহায্য নিয়ে বুঝে নিচ্ছেন নিয়মিত, সব সময় ভাইবটা ধরার চেষ্টা করছেন এই কোচ। চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টির আগে সংবাদ সম্মেলন শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পাওয়া যায় তার আঁচ। একটি ইংরেজি ক্রিকেট পোর্টালের করা লেগ স্পিনারদের নিয়ে স্টোরি নিয়ে ওই প্রতিবেদককে ডেকে বলেন, 'দেখ, খুব ভালো লিখেছ। কিন্তু ২০১৫ সালে আমি যখন মরিয়া হয়ে লেগ স্পিনার খেলাতে চাইতাম তোমরাই বিরোধিতা করতে।' তারপর খানিকক্ষণের হালকা ঢঙের আলাপে বোঝালেন বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বেশ ভালোই অনুসরণ করেন তিনি। কার কি মতিগতি এসব বুঝে নিতে চান ভালো করে।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের আগে শুক্রবার সিলেটেও দলের হয়ে কথা বলতে আসেন হাথুরু। তাতে কখনো চোয়াল শক্ত করে জবাব দিতে হয়েছে, কখনো ভ্র কুঁচকে জানিয়েছেন নিজের স্পষ্ট অবস্থান। কথার মাঝে স্ত্রীর ফোন কল চলে এলে রাশভারী আদল ছেড়ে হাস্যরসেও মাতিয়েছেন খানিকটা।
কঠিন প্রশ্ন ছিল মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে। ওয়ানডেতে টুকটাক রান পেলেও মাহমুদউল্লাহর খেলার ধরণ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। পরিস্থিতির চাহিদা মেটাতে না পারা মন্থর ব্যাটিংয়ের সঙ্গে বাজে ফিল্ডিং তার জায়গা করে দেয় নড়বড়ে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্রামের আদলে তার না থাকা ইঙ্গিত দেয় সমাপ্তির। কিন্তু হাথুরুসিংহের মন্তব্য সত্য মানলে মিলবে পুরো ভিন্ন ছবি। প্রথমেই প্রশ্নকর্তাকে বললেন, 'আপনি তো মন্তব্য করে ফেললেন, আমাকে আর জিজ্ঞেস করা কেন? তবে আপনার মন্তব্যে আমি পুরোপুরি একমত না।' এরপর দিলেন তার ব্যাখ্যা, 'আমার মনে হয় না সে তার সেরা সময় পেরিয়ে এসেছে। আমরা আসলে বিশ্বকাপের আগে আমাদের পুলটাকে বড় করতে চাইছি। যদি বিশ্বকাপের আগে কিছু ঘটে যায়, তাহলে পর্যাপ্ত খেলোয়াড় থাকেল। রিয়াদ এখনো আমাদের পরিকল্পনায় আছে।'
তার এই মন্তব্য আসল বাস্তবতা ধরার উপায় নেই। কিন্তু কূটনৈতিক বুদ্ধিদীপ্তি আছে। এই অবস্থানের সঙ্গে মিল আছে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও দুই নির্বাচকদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের। এমনটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় সাম্প্রতিক সময়ে তা স্বাভাবিক ছিল না। কোন একটা বড় সিদ্ধান্তের পর টিম ম্যানেজমেন্ট, বোর্ড কর্তা, কোচ সবার একেক রকম মন্তব্যের মাঝে সমন্বয় দেখা যেত না। এবার সেই জায়গায় লক্ষণীয় একটা বদল এসেছে। মাহমুদউল্লাহকে দলে বাইরে রেখে গণমাধ্যমে ঠিক কি বলতে হবে, এটা খুব সতর্কভাবে সামলানো হচ্ছে।
এটা সত্য, অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটারের দুয়ার একবারে বন্ধ না। আবার খুব ফেরার রাস্তা যে সহজও না। তার জায়গায় তৌহিদ হৃদয়, ইয়াসির আলিদের যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হবে। পরিস্থিতির দাবি মেটানো ব্যাটিং তারা কেউ করতে পারলে পিছু ফিরবে না বাংলাদেশ, কোন গণমাধ্যমও চাইলে তুলতে পারবে না প্রশ্ন। আরেকটি সিরিজের আগে তাই এই বিতর্কের আর জায়গা রাখছেন না তিনি।
আইরিশদের বিপক্ষে সিরিজের আগে সাকিবের ব্যাটিং পজিশন, আফিফের ব্যাটিং, মাহমুদউল্লাহর না থাক, রনি তালুকদারের যুক্ত হওয়া মিলিয়ে অনেক প্রশ্নের জবাবের পর লঙ্কান কোচ দিলেন খোঁচাও, 'ব্যাটারদের নিয়ে এতগুলো প্রশ্ন, বোলিং নিয়ে প্রশ্ন নাই? বোলাররা তো ভালো করছে।'
তার এই কথার পর বোলারদের বিশেষ করে পেসারদের নিয়ে প্রশ্ন গেল। তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদদের প্রশংসা তিনি আর নতুন করে কী করবেন। তবে গত বছর দেড়েক মোস্তাফিজুর রহমানের পারফরম্যান্স নিয়ে যে হইচই হচ্ছিল, সেদিকে দিলেন বিশেষ নজর। প্রচুর উইকেট না পেলেও মোস্তাফিজ যে দারুণ বল করছেন ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাইলেন বাংলাদেশের কোচ। গণমাধ্যমের প্রতিও আহবান জানালেন, এসব 'ইম্পেক্ট' পারফরম্যান্স যেন তারা তোলে ধরেন, 'আপনাদের লেখা ক্রিকেটাররা পড়ে, রিপোর্ট দেখে। কাজেই যদিও ছোট ছোট মুহূর্তে কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ফেইজের পারফরম্যান্স যদি তুলে ধরেন তাহলে সবাই অনুপ্রাণিত হয়।'
কোনো ম্যাচে কেউ ভালো করবে, কেউ খারাপ করবে। কিন্তু 'ক্যারেক্টার' কিংবা শরীরী ভাষায় 'ঝাঁজ' দেখাতে পারছে কিনা এটাই আপাতত হাথুরুসিংহের পাশ-ফেলের প্যারামিটার। খেলোয়াড়দের ভেতর একটা 'অ্যাটিচ্যুড' দেখতে চান। তিনি নিজেও 'অ্যাটিচ্যুড' রেখে দায়িত্ব সামলাতে চান। সেটা কতটা পারবেন তা হয় বলে দেবে সময়।
Comments