ভেনিসের প্রথম বাংলাদেশি চিকিৎসক রাসেল

বাবা-মা ও ২ ভাইয়ের সঙ্গে ডা. রাসেল মিয়া। ছবি: সংগৃহীত

ইতালির ভেনিসে বাংলাদেশি কমিউনিটির সূচনা হয় প্রায় ২৫ বছর আগে। তখন হাতেগোনা কজন বাংলাদেশি অভিবাসী এই শহরে বসবাস করতেন। ধীরে ধীরে কমিউনিটি বড় হতে থাকে। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি অভিবাসীর শহর ভেনিস। অনেকেই পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। তাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুল কলেজে পড়াশোনা করে। বাবারা অধিকাংশ কল-কারখানা, রেস্তোরাঁ বা পর্যটন সংশ্লিষ্ট চাকরিতে আছেন। কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যও করেন। মায়েদের বড় অংশ ঘর-গৃহস্থলির কাজ করেন। কেউ কেউ চাকরিও করেন।

অভিবাসী বাংলাদেশিদের প্রথম জেনারেশন বা ছেলে-মেয়েদের একটা বড় অংশ এখন পূর্ণ যৌবনে পা দিয়েছে। কেউ কেউ কর্মজীবন শুরু করেছে। পছন্দের মানুষকে বিয়ে করে সংসারও পেতেছে অনেকে। কিন্তু ছেলে-মেয়েদের একটা বড় অংশ লেখাপড়া শেষ করেনি বা করতে পারেনি। 'ও' লেভেল থেকেই তারা ঝরে পড়েছে। সংসারের হাল ধরেছে। বাবা-মাকে আর্থিক সহযোগিতার জন্য কর্মজীবনে নেমে পড়েছে। তাদের মধ্যে যারা লেখাপড়া শেষ করেছেন, তাদের একজন রাসেল মিয়া। ভেনিসের প্রথম বাংলাদেশি চিকিৎসক।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন রাসেল মিয়া। ১১ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ইতালি চলে আসেন। তখন রাসেলের বাবা একটি জাহাজ নির্মাণ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। থাকতেন ভেনিসের উপশহর মেসত্রেয়। স্থানীয় স্কুল-কলেজের লেখাপড়া শেষ করে রাসেল ভর্তি হন পাদোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বপ্ন দেখেন চিকিৎসক হওয়ার। চিকিৎসক হয়ে মানুষকে সেবা দেবেন।

রাসেল বলেন, 'প্রত্যেক মানুষকেই একটা সময়ে পেশা বেছে নিতে হয়। আমি ছোট সময় থেকেই ঠিক করি চিকিৎসক হব। মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেবো। বাবা-মার উৎসাহ ও সহযোগিতায় আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, আগামীতে আমাদের কমিউনিটি থেকে আরও অনেকে চিকিৎসক হবেন।'

রাসেল পাদোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিসিন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি অ্যান্টিবডি ডোজের ওপর গবেষণা করেন। ইতমধ্যে তার গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছে।

ইতালীয় চিকিৎসা পদ্ধতির অন্যতম প্রধান দিক হলো সব নাগরিককে ব্যক্তিগত চিকিৎসক নিবন্ধন করতে হয়। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এসব চিকিৎসকরা রোগীদের বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেন এবং কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন হলে তার অনুমোদন দেন। ইতালীয় ভাষায় যাদের বলা হয় 'মেদিকো বাজে'। মেদিকো বাজের বেতন হয় সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে।

সহকর্মীদের সঙ্গে ডা. রাসেল। ছবি: সংগৃহীত

ডা. রাসেল আগামী ১ এপ্রিল 'মেদিকো বাজে' হিসেবে ভেনিসের ভিয়ালে সান মারকো (মেসত্রে) এলাকায় কাজ শুরু করবেন। প্রথম বছর ১ হাজার মানুষ তাকে ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে নিবন্ধন করতে পারবে। পরবর্তী বছরে যা ১ হাজার ২০০ পর্যন্ত হতে পারে।

বাবা-মা, ছোট ২ ভাই ও স্ত্রীকে নিয়ে মেসত্রে বসবাস করেন রাসেল। তার ভাই রুবেল মিয়া পাদোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন ও ফার্মাসিউটিক্যাল প্রযুক্তিতে পড়াশোনা করছেন।

রাসেল বলেন, 'ছেলে-মেয়েদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে বাবা-মার উৎসাহ থাকতে হবে। অর্থিক ও মানসিকভাবে ছেলে-মেয়েকে সহযোগিতা করতে হবে। আর ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও চেষ্টা, সাধনা থাকা প্রয়োজন।'

'অভিবাসী বাবা-মায়েদের অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য হলেও আমাদের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। লেখাপড়া করে তাদের ও কমিউনিটির মুখ উজ্জ্বল করতে হবে', যোগ করেন তিনি।

রাসেল এখনো শুধু বাংলাদেশি নাগরিক। অর্থাৎ ইতালীয় নাগরিকত্ব তার নেই। এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'বাবা-মার আর্থিক ও ডকুমেন্টগত সমস্যার কারণে এখনো ইতালীয় নাগরিকত্ব পাইনি। তবে আবেদন করেছি। হয়তো পেয়ে যাব অল্প দিনে।'

স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণ করে রাসেল বলেন, '২০০৩ সালে আমি যখন ইতালিতে আসি এবং স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি হই, তখন আমি এক বিন্দুও ইতালির ভাষা জানতাম না। ক্লাসে বোকার মতো তাকিয়ে থাকতাম। সে সময়ের সহপাঠীরা বিদেশি ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিশতে অভ্যস্ত ছিল না। আমাকে নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ কৌতুহল ছিল। কেউ কেউ হাসাহাসিও করত। কিন্তু শিক্ষকরা ছিলেন অমায়িক মানুষ। তাদের সহযোগিতায় আমি অল্প দিনে তরতর করে এগিয়ে যাই।'

'সত্যিই আমার ওই শিক্ষরা ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। আমি যখন স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করি, তখন প্রথা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসব করা হয়। সহপাঠীরা রাস্তার মধ্যে আমাকে বেলি ড্যান্স দিতে বাধ্য করে, যা মনে পড়লে এখনো হেসে ফেলি', বলেন তিনি।

গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট রাসেল বলেন, 'আমি বাংলাদেশ ও ইতালীয় সংস্কৃতির মানুষ। আমি একইসঙ্গে ২ সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করি। উভয় সংস্কৃতির মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা পেতে চাই। তাদের সেবা করে যেতে চাই।'

ডাক্তার রাসেল ভেনিসের প্রথম ও ইতালির ৪র্থ বাংলাদেশি চিকিৎসক। এ ছাড়া ইঞ্জিনিয়ার, প্রকৌশলী, স্থপতি, হিসাবরক্ষক, পুলিশ, পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনার পর্যায়ের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন বাংলাদেশি কমিউনিটি থেকে।

Comments

The Daily Star  | English
explanations sought from banks for unusual USD rates

Explanations sought from 13 banks for higher dollar rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

2h ago