‘টাকা দিয়ে নিরিবিলি কিনতে হলে বুঝতে হবে সেই সমাজে মৌলিক কোনো গোলমাল হয়ে গেছে’

দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে দীপেশ চক্রবর্তী। ছবি: রাশেদ সুমন

দীপেশ চক্রবর্তী একজন ভারতীয় বাঙালি ইতিহাসবিদ। উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাবলটার্ন স্টাডিজে অবদানের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন সঙ্গে মানব সমাজের ইতিহাসের সম্পর্কের ব্যাপারে তার কাজ বিশ্বজুড়ে আগ্রহ তৈরি করেছে।

গত সোমবার বিকেলে ঢাকায় দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে আয়োজিত এক সভায় বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এই অধ্যাপক। তার বক্তব্যে জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর ভৌত বিবর্তনের সঙ্গে সমাজের সম্পর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের সমকালীন সংকটের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে।

দীপেশ চক্রবর্তী বলেছেন, কোনো সমাজে যদি টাকা দিয়ে নিরিবিলি কিনতে হয় তাহলে বুঝতে হবে সেই সমাজে মৌলিক কোনো গোলমাল হয়ে গেছে। যেখানে দুজন মানুষের কথা বলার জন্যও অর্থ খরচ করতে হচ্ছে সেখানে বুঝতে হবে মানুষের দৃষ্টি থেকে জীবনের আসল তাৎপর্য সরে গেছে। সেখানে টাকা অসুস্থতার লক্ষণের মতো। এগুলো অসুস্থ সমাজ।

তার মতে, বৈষয়িক উন্নয়ন নিয়ে ঘোরের মধ্যে থাকার কারণে আমাদের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। উন্নয়ন বলতে এখন যা বোঝানো হচ্ছে তার সঙ্গে বাসযোগ্যতার সংঘাত তৈরি হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানবজাতির আসন্ন বিপদ সম্পর্কে দীপেশ চক্রবর্তী বলেন, যদি এভাবেই চলতে থাকে আর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিপদ নিয়ে বিজ্ঞানীদের অনুমান সঠিক হয় তাহলে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে পৃথিবীকে আর চেনা যাবে না।

তিনি বলেন, বেঙ্গল ডেল্টা, আমাজান ডেল্টার বয়স ছয় হাজার বছর। ছয় হাজার বছর আগে এগুলো ছিল না। ১২ হাজার বছর আগে শেষ বরফ যুগের অবসান হয়েছে। কৃষি যুগ শুরু হয়েছে ১০-১২ হাজার বছর আগে। শহুরে সভ্যতা শুরু হয়েছে চার হাজার বছর আগে। আমরা যেগুলোকে নতুন ধর্ম বলি সেগুলো এসেছে শহর সভ্যতা শুরু হওয়ার পর। আমরা যাকে শিল্প সভ্যতা বলি তার বয়স দেড়শ বছরের মতো। আজকের ভোগবাদী সমাজ শুরু হয়েছে ১৯৫০ সালের পর যেটা সত্তরের দশকের পর হুহু করে বেড়ে গেছে। ১৯৪৫ এ পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ৩০০ কোটির মতো। তখন যদি আমরা পারমাণবিক শক্তি গ্রহণ করতাম তাহলে উষ্ণায়ণের গল্পটা এমন হতো না।

সভ্যতার গতিপথের কাছে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে দীপেশ চক্রবর্তী বলেন, সত্যি সত্যি যার বাঁচা-মরার প্রশ্ন তার অসহায় হলে চলে না। ধরুন আপনার ঘরে পানি ঢুকে পড়ছে, তখন আর উদাসীন থাকার উপায় থাকে না। সে জন্য যারা সত্যিই দুর্দশায় আছে তাদের ক্রিয়া করতেই হয়।

নদী থেকে বালি তুলে ফেলে কারণে ভারতের নদীগুলো হুমকির মুখে থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, নির্মাণ কাজের জন্য বালির প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু নদীর ক্ষতি করলে আখেরে আমাদেরই ক্ষতি হয়। আমার মনে হয় চীন ও ভারত এখনো ভূরাজনীতিতে ব্যস্ত। ভূরাজনীতি থেকে সরে এসে এখন ভূতাত্ত্বিক রাজনীতির সময় চলে এসেছে।

পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের মুখে বাংলা অস্তিত্বের সংকটের ব্যাপারে তিনি বলেন, সেখানে বাংলার ভবিষ্যৎটা খুব ভালো দেখছি না। সংস্কৃতির প্রসারণের জন্য সমাজের ধনবান মানুষদের বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। ভাষা সংস্কৃতির প্রসারের জন্য বিনিয়োগ দরকার হয়। এদিক থেকে আমরা সংকটের মধ্যে আছি।

দীপেশ চক্রর্তী বলেন, মানুষ এখন একটা ভূতাত্ত্বিক শক্তির পর্যায়ে পৌছে গেছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, যেরকম একটা উল্কাপাত হয়ে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তেমনি সংখ্যা ও প্রযুক্তির জোরে মানুষই এখন অন্য প্রজাতি ধ্বংস করছে। এর আগে পৃথিবী থেকে প্রাণের পাঁচটি মহাবিলুপ্তি ঘটেছে। আবার মহাবিলুপ্তি ঘটলে যেটা মানুষের কারণেই ঘটবে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি প্রাণী পৃথিবীতে প্রাণের মহাবিলুপ্তি ডেকে আনবে। আগে কখনো কোনো প্রাণের প্রজাতি পৃথিবীতে এমন সমস্যা নিয়ে আসেনি।

'আমরা বরাবরই ভাবতাম মানুষ ন্যায়বিচার চায়। মানুষ ন্যায়বিচার দেয় না কিন্তু চায়। মানুষ সব সময় ভাবে আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। এরকম একটা বোধ নিয়ে আমি কাজ করতাম। ভাবতাম মানুষের ইতিহাস আর প্রকৃতির ইতিহাস আলাদা। উনবিংশ শতাব্দীতে ইতিহাসে এরকম একটা তত্ব ছিল। আমরা ধরে নিতাম যে প্রকৃতি তার নিজের নিয়মের অধীন।

তিনি বলেন, 'মানুষের ইতিহাস আর প্রকৃতির ইতিহাস আলাদাভাবে দেখা যায় না। কারণ মানুষ প্রকৃতির ইতিহাসের অংশ। আমাদের যেমন ভূতত্ত্ব বুঝতে হবে তেমনি জীববিজ্ঞানও বুঝতে হবে। কারণ মানুষ এখন এগুলোর ওপর প্রভাব ফেলছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, মানুষ যত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করেছে তার মধ্যে ৮৭ ভাগ ব্যবহার হয়েছে ১৯৮৭ সালের পর। প্রাক মানুষের প্রজাতির বয়স ২৫ লাখ বছরের। এরাই প্রথম আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে। এরপর বিভিন্ন কারণে মানুষের আয়ু বেড়েছে। ১৯০০ সালে এসে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়েছে। এর পর ১০০ বছরে মানুষের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬০০ কোটি। আজকে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ৮০০ কোটি ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৪০০-৫০০ কোটি মানুষ মোটামুটি ভালো আছে। যারা ফ্রিজ কেনে, গাড়ি কেনে এমন ভোগী মানুষের সংখ্যা ১৯৮৬ সালে এসে ১০০ কোটি ছাড়িয়েছে। এখন এ ধরনের মানুষের সংখ্যা ৪০০-৫০০ কোটি। খুবর দ্রুত এই সংখ্যা বেড়েছে। ২০০০ সালে এই ভোগী মানুষদের ৭০ ভাগ ছিল সাদা চামড়ার মানুষ। এখন এই অংশটির ৭০ ভাগই চীন, ভারত, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার মানুষ। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, বিশেষ করে গরিব মানুষের আয়ু বেড়েছে।

এই বিপুল সংখ্যক মানুষের খ্যাদ্য চাহিদা মেটাতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়টায় কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শুরু হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে অবসরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। হাতে টাকা থাকলে মানুষের আমিষ খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। এটা ন্যয্য ব্যাপার। কিন্তু আমিষ খাওয়া মানে অন্য একটা যন্তুকে খাওয়া। এর জন্য আমাদের পশুপালন করতে হয়। ফলে পশুপাখির জীবন নিয়ে এখন শিল্পায়ন হয়েছে। পৃথিবীতে এখন পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১ বিলিয়ন আছে ব্রয়লার মুরগি। এর পর প্রকৃতিতে যে পাখিটি সবচেয়ে বেশি আছে তার সংখ্যা দেড় বিলিয়ন। পৃথিবীতে এখন যত গরু আছে, মানুষ না থাকলে এত থাকত না। মাংস সরবরাহের জন্য পৃথিবীতে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। এই গ্যাস আবার জলবায়ু পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।

Comments