অবৈধ ইটভাটার জন্য চলছে পাহাড়-গাছ কাটা
বান্দরবানে ৭টি উপজেলায় প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে পাহাড়ি বনের কাঠ পুড়িয়ে অবৈধভাবে চলছে ৭০টির বেশি ইটভাটা।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে বান্দরবানের ২৭টি ইটভাটা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিলেও, দেশের প্রচলিত আইনকে তোয়াক্কা না করে কৃষিজমি, জনবসতি, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা।
গত ২ মার্চ সকালে গুংগুরুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এবিসি ইটভাটাসহ বান্দরবানের ২৭টি ইটভাটার বিরুদ্ধে হাইকোর্টের দেওয়া রায় দ্রুত কার্যকরের দাবিতে বাংলাদেশ খেয়াং স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ও গুংগুরু পাড়াবাসীর ব্যানারে একটি মানববন্ধন হয়।
মানববন্ধনে বাংলাদেশ খেয়াং স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সভাপতি জনি খিয়াং বলেন, 'এই ইটভাটার কারণে আমাদের গ্রামের ও পাশের এলাকায় প্রাকৃতিক বনভূমি উজাড় ও ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় ঝিরি শুকিয়ে গেছে। এর ফলে অনেক ফসলি জমি নষ্ট হয়ে গেছে। ইটভাটার চুল্লির ধোঁয়ায় স্কুলের শিক্ষার্থী ও গ্রামের প্রবীণরা সারা বছর কাশিতে ভুগছেন।'
'এবিসি' ইটভাটার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বান্দরবানের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের 'ব্যবসা ও বাণিজ্য শাখা' থেকে ২০০৫ সালের ৩ নভেম্বর ৩ বছরের জন্য অনুমোদন পেয়েছিল ইটভাটাটি। এরপর আরও ২ দফায় ৩ বছর করে ৬ বছরের জন্য ভাটা নবায়ন করা হয়।
কিন্তু জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের 'ব্যবসা ও বাণিজ্য শাখার' ২০১০ সালের একটি আদেশে ইটভাটাটি সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কৃষি জমি, স্থানীয় গ্রামবাসীর লোকালয় ও গুংগুরু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষতির কারণ হওয়ায় বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বান্দরবানের অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশে হাইকোর্টের দেওয়া রায়কে তোয়াক্কা না করে গুংগুরুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে গড়ে তোলা অবৈধ ইটভাটাটি এখনো চলমান আছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অবৈধ এবিসি ইটভাটার মালিক মোহাম্মদ ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গ্রামবাসী এবং পাড়াবাসীরা যে অভিযোগ করছে, তার সবই মিথ্যে। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই, সব বানোয়াট।'
হাইকোর্টের রায়ে অবৈধ ইটভাটার তালিকায় এবিসি ইটভাটার নাম দ্বিতীয়তে আছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ ইসলাম নিজেকে একটি পত্রিকার সম্পাদক দাবি করে বলেন, 'আমি হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে শুনিনি এবং কিছুই জানি না। আইনের বিষয়ে আমাদের সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।'
সরেজমিনে জেলার লামা, আলীকদম এবং নাইক্ষ্যংছড়িতেও কয়েকটি ইটভাটার কার্যক্রম চলমান দেখা যায়।
ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে পাহাড়ি বনের কাঠ ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবান জেলার বন বিভাগের কর্মকর্তা ইমদাদুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইটভাটার কারণে বনের অনেক কাঠ নষ্ট হয়েছে। ইটভাটাগুলোতে বনের ছোট-বড় গাছগুলোকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করায় পাহাড়ি প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের পাশাপাশি পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিবেশ, আবহাওয়ার, জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।'
তিনি আরও বলেন, 'পাহাড়ে ইটভাটা স্থাপনের আগে মালিকদের জেলা প্রশাসন থেকে লাইসেন্স দেওয়ার সময় বন বিভাগকে জানানো হয় না। এ জন্য পাহাড়ে কোথায় কোথায় ইটভাটা স্থাপন হয়, তা আমাদের জানা থাকে না। তারপরও সংরক্ষিত বনাঞ্চল সংলগ্ন ভাটাগুলোতে মাঝে মাঝে বন বিভাগের যৌথ অভিযান চালানো হয়। এ ছাড়া বন বিভাগের আর কিছুই করার নেই।'
বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. ফখর উদ্দিন চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাইকোর্টের রায়ের নির্দেশনা মেনে বান্দরবানে সব অবৈধ ইটভাটা দ্রুত বন্ধ করতে বড় ধরনের অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। শিগগির আমরা অভিযান পরিচালনা করব।'
জানতে চাইলে বান্দরবানের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ২০০৮ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ পার্বত্য জেলায় ইটভাটা নির্মাণ বা স্থাপনার কোনো অনুমতি নেই। তাই বান্দরবানে যত ইটভাটা আছে, সবগুলো অবৈধ। শিগগির আমরা প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামব।'
Comments