কপ্টারে বিয়ে বিলাস: মাল-মালিকে ৫ টন

বিশাল ব্যাপার একেকজনের। কেউ অতিরিক্ত সচিব, কেউ যুগ্ম সচিব, সহকারী সচিব। সরকারি অফিসেরই একটি রুমে বসে চাকরির পরীক্ষা নিয়েছেন। এরপর কিউআর কোডযুক্ত নিয়োগপত্রও তুলে দেন চাকরিপ্রত্যাশীদের হাতে। কিন্তু, চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে তারা টের পান, সব ভুয়া।

আলমগীর হোসেন, রেজাউল হক ও হুমায়ূন কবিররা কোনো সচিবই নন, স্রেফ ঠকবাজ। গণপূর্ত অধিদপ্তরের কারো যোগসাজস ছাড়া এমনি এমনিতেই ঘটে গেছে এমন কাণ্ড?

গণপূর্তের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে চাকরি দেওয়ার নামে ৩ শতাধিক প্রার্থীর প্রায় প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ থেকে ১২ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ না উঠলে উপরোক্ত ৩ ভুয়া সচিবসহ ৭ প্রতারক হয়তো ধরাও পড়তো না। এরা চাকরি প্রার্থীদের কোচিং করিয়েছে, প্রশ্ন আউটের মতো অনেক কিছু শিখিয়েছে। এরপর সিরিয়াল ধরে পরীক্ষা নিয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল দৃষ্টে চাকরির নিয়োগপত্রও দিয়েছে।

গত বছরের ৬ এপ্রিল গণপূর্ত অধিদপ্তর ১৪ থেকে ১৬ গ্রেডের বিভিন্ন পদে ৪৪৯ জনকে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। এর আলোকে এরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকরিপ্রত্যাশীদের জোগাড় করেছে। পরিশ্রম কম করেনি। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অবাধ যাতায়াত, চালচলনসহ আনুষঙ্গিক কাজে তাদের অনেক খরচও হয়।

তাদের কাছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীসহ সরকারি চাকরিজীবীরা আসেন। মাঝেমধ্যে অনেকের চাকরি পাইয়ে দেওয়াসহ অনেক কাজ করে দেন। মুশকিল আসানও করে দেন। গাড়ি-বাড়িসহ বিশাল বিত্তবৈভব তাদের। প্রতারিতরা অভিযোগ না করলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশেরও তা জানা হতো না। তারা ধরাও পড়তো না।

যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের চাকরিচ্যুত তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবদুল মালেক শত কোটি টাকা হাতানোর খবরও বাজারে এসেছে তার লাপাত্তা হওয়ার পর। তাও প্রতারণার শিকাররা অভিযোগ না করলে অজানাতেই পড়ে থাকত। মালেক ঘুরে বেড়াতেন শাহেনশাহ হয়েই। ১৯টি ব্যাংকে এই মালেক ও মিসেস মালকের ২৬টি অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার খোঁজ মেলার আগ পর্যন্ত পুলিশও তৎপর হয়নি। দাপ্তরিক দুর্নীতি-অনিয়ম-ঘুষ লেনদেনের চেয়ে চাকরি দেওয়ার প্রতারণা বাণিজ্যই বেশি করেছেন এই মালেক।

কেবল প্রতারণা নয়, ভুক্তভোগীদের কেউ টাকা ফেরত চাইলে তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়ে জেলের ভাত খাইয়ে উচিত শিক্ষা দেওয়ায় পাকা হাত তার। প্রতারণার বেশিরভাগই হয়েছে চাকরি দেওয়ার নামে। ঢাকায় ৩টি ফ্ল্যাট, কুষ্টিয়া শহরে মার্কেট, বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হয়ে মালেক এখন গায়েব।

তার চাকরি ২০০৪ সালে যশোর জেলা সদরের আঞ্চলিক কৃষি অফিসের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়ে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে। প্রতারণার বিভিন্ন অভিযোগের কারণে পরবর্তীকালে তার চাকরি চলে যায়। এর আগ পর্যন্ত নগদে-চেকে লাখ-লাখ টাকা দিয়ে তার কাছে প্রতারিত হয়েও চুপ থেকেছেন ভুক্তভোগীরা। ততক্ষণে বহু টাকা ও সম্পদের মালিক হয়ে চম্পট দিয়েছেন মালেক।

কিন্তু পালানোর দরকার মনে করেননি স্বাস্থ্যের মালেক। অপকর্মের ধরনে মালেকরা প্রায় একই। তাদের মালিকরাও তাই। কেউ কৃষিতে, কেউ স্বাস্থ্যে। তারা সম্পদ, দায় নন। তাদের সঙ্গে বহু মাল-মালিকের সন্নিবেশ।

কৃষির তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবদুল মালেক নিজ এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এজেন্ট নিয়োগ করে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করতেন, ২০১৬ সাল থেকে অ্যাম্বিশন কোচিং সেন্টার চালু করে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্য থেকে জেলা, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধা, এতিম ইত্যাদি কোটার শ্রেণিকরণ করতেন। তিনি যে টাকা নিতেন, তা কেউ জানতেন না? তিনি একাই করেছেন? মোটেই না। উপরে-নিচে বহু সহযোগী ছিল তার।

স্বাস্থ্যের ড্রাইভার মালেকের অপকর্মের সহযোগী ছিলেন অনেকে। কৃষি বা স্বাস্থ্যের মালেকরা নানান কিছুর মালিক হতে বহু সহযোগী পান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে বহু কর্মচারীর নিয়োগ, টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া, মেডিকেলে শিক্ষার্থী ভর্তির পেছনে মালেকের হাত থাকার তথ্য খবরে রূপ নিয়েছে তার ধরা পড়ার পর। উপরস্থদের সম্পৃক্ততা ছাড়া মালেকরা এতো কিছু করতে পারেন না।

তিনি ধরা পড়ার পর শোনানো হয়েছিল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের অন্তত ২ ডজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কড়া অ্যাকশন নেওয়া হবে তাদের বিরুদ্ধে। কিছু ধরপাকড়ও হয়। পরে বহু ল্যাটা চুকে গেছে। এ বিষয়ক আর ফলোআপও থাকেনি। নতুন মালেক, মালিক, আবজালদের দাবায়ে রাখা যায়নি। মাঝে মধ্যে ঘটনাচক্রে দুয়েক পিস নিয়ে খবরের বাজার জমলেও তা ঢেকে যায় বড় আরও কোনো ঘটনা বা ইস্যুর তোড়ে।

এ ধারাপাতে যোহ হয়েছে আরও মালেক। বহু বছর ধরে এসব মালেক-আবজালরা আছেন। ধরা না পড়লে তারা কোথাও ড্রাইভার-পিয়ন বা প্রতারক থাকেন না। পরিচিত হন 'সাহেব' বা অন্য কোনো পদ-পদবি ও সম্বোধনে। ড্রাইভার নয়, পাইলট বললেও কেউ খতিয়ে দেখার দরকার মনে করেন না। একটু দূরের পথ হলে দামি গাড়ি নয়, হেলিকপ্টার ভাড়া করে চলার রেকর্ডও রয়েছে এই মাল-মালিকদের। তাদের স্ত্রী-সন্তানদের   বিলাসী জীবন।

চট্টগ্রামে একমাত্র মেয়ের আবদার রাখতে বরখাস্ত ট্রাফিক পুলিশ কনস্টেবল মহিবুল্লাহর আড়াই লাখ টাকা খরচ করে হেলিকপ্টার ভাড়া করার মাঝেও রয়েছে সেই বার্তা। বরখাস্ত একজন ট্রাফিক পুলিশ কনস্টেবল কোথায় পেলেন এতো টাকা? এ প্রশ্নের স্পষ্ট জবাবও দিয়েছেন বিশাল অঙ্কের চাঁদাবাজির অভিযোগে বরখাস্ত কনস্টেবল মহিবুল্লাহ। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক পরিচয় জানিয়ে তার প্রোফাইল জানার তাগিদসহ সাংবাদিককে বলে দিয়েছেন, 'আমার সম্পর্কে আগে জানেন, তার পরে ফোন দেন।'

চাছাছিলা হলেও উচিৎ কথা বলেছেন বরখাস্ত কনস্টেবল মহিবুল্লাহ। মাল-মালিক-মহিবুল্লাহদের প্রোফাইল সামনে আসে তারা ঘটনা চক্রে গর্ত পড়লে। নইলে শানে-মানে অধরাই থাকেন। সাধারণের মাঝে অসাধারণ হয়ে বিচরণ করেন 'সাধারণ পরিবহণ' ট্রাকের মতো। কৃষি-স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সব খাতে। 'সাধারণ পরিহণ, ৫ টন, সমগ্র বাংলাদেশ' বাক্যটির অর্থ স্বচ্ছ না হলেও এর নিচে 'সাবধান, বিপজ্জনক, ১০০ হাত দূরে থাকুন' বাক্যটির অর্থ পরিস্কার। কিন্তু, সেদিকটায় সময় থাকতে নজর পড়ে না অনেকের। এটাই বাস্তবতা।

এই বিপজ্জনকদের থেকে দূরে থাকা অসম্ভব বিধায় দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে এনে মেনে নেওয়ার তত্ত্ব দিয়ে ব্যঙ্গ আইটেমে পরিণত হয়েছিলেন আলোচিত সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। আর ঘুষকে 'ঘুষ' না বলে 'স্পিডমানি' বলার রসিকতা করে অর্থমন্ত্রী থাকার সময় ট্রলের শিকারে পড়েন তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিছুদিন পর ঘুষ নিয়ে বোমা ফাটানো মত দেন ওই সময়কার দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। 'সরকারি কর্মকর্তারা সরল বিশ্বাসে ঘুষ খেলে অপরাধের মধ্যে পড়বে না, সেটা প্যানাল কোড সিআরপিসিতে আছে' মন্তব্য করায় রঙ্গব্যঙ্গ হয় তাকে নিয়েও। সুইস ব্যাংক, কানাডার বেগমপাড়াসহ বিদেশে হাজারো কোটি টাকা পাচারকে 'পাচার' না বলে 'লেনদেন' বলার পরামর্শও আসে। মজা করতে গিয়ে অনেকে বলছিলেন, পাচার-লেনদেন না বলে 'টাকা রপ্তানি' বলে দেওয়া আরও ভালো।

এ ধরনের মশকারা বা রসকথার মধ্যেই মাঝেমধ্যে সামনে আসে মালেকদের নাম। মালিকরা থাকেন আবডালেই। দেশের প্রতিটি খাতে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতিকে দুর্নীতিবাজরা মানুষের কাছে সহনীয় করে দিতে পেরেছে। দুর্নীতি করলে শেষতক কিছু হবে না, এ ধারণা মালেকদের-মালিকদেরও।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
fire at Secretariat

Secretariat fire sabotage or accident still not known: Fire service DG

Muhammad Jahed Kamal, director general of the Fire Service and Civil Defence, today said the cause of the devastating fire at Building No. 7 of the Bangladesh Secretariat still remains unknown

57m ago