দারিদ্র্য পারেনি স্বপ্ন কেড়ে নিতে

ভাষানটেক বস্তির আবুলের চায়ের দোকান। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

রাজধানীর ভাষানটেকে 'আবুলের বস্তি'তে সবার পরিচিত আবুলের মুদি ও চায়ের দোকান। মালিক আবুল হোসেন প্রায়ই দোকানের জন্য জিনিসপত্র কিনতে ব্যস্ত থাকেন। তাই সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দোকান চালায় তার ২ মেয়ে।

চা বানানো, কাপ ধোয়া বা মুদি মালামাল বিক্রি করাসহ দিনভর পরিশ্রম করতে হয় দুই বোন পাপিয়া আক্তার (১৮) ও মেঘলা আক্তারকে (১৭)।

ভাষানটেক কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী এই ২ বোন বস্তির বাসিন্দাদের জন্য একটি আশা জাগানিয়া উদাহরণ।

এ বস্তিতে প্রায় ৪০০ পরিবারের বাস। এসব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মাত্র ৪ জন কলেজে পড়াশোনা করছে।

পাপিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের যখন ক্লাস থাকে তখন বাবা দোকানে বসেন। একসঙ্গে পড়াশোনা ও দোকান চালানো বেশ কঠিন।'

'ছোটবেলা থেকেই বাবা চাইতেন আমরা যেন লেখাপড়া চালিয়ে যাই। বস্তিতে আমরা যেন উদাহরণ হয়ে থাকি। পাশের পুলিশ ব্যারাক ও সেনানিবাসের কর্মকর্তাদের দেখে আমরা উৎসাহ পেতাম। সবসময় তাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।'

আরও বলেন, 'আমাদের জন্য এমন সুযোগ আসবে কি না, জানি না। সারাদিন কাজের পর পড়াশোনায় ভালো করা কঠিন।'

আবুল হোসেন ডেইলি স্টারকে জানান, মেয়েদের কলেজের বেতন, প্রাইভেট টিউশন ও অন্যান্য খরচ বাবদ মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বছর তাদের ভর্তির জন্য অতিরিক্ত ১২ হাজার টাকার প্রয়োজন।

তিনি বলেন, 'যদি এই টাকা সঞ্চয় করতে পারতাম, তবে আরও ভালো জায়গায় থাকতে পারতাম। মেয়েদের খুশিমতো খাওয়াতে-পরাতে পারতাম। ওদের যদি বাইরে কাজ করতে দিতাম, তাহলে প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা করে আয় করতে পারত।'

'আমি সবসময় তাদের লেখাপড়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। আমার বিশ্বাস, শুধু জ্ঞানের আলোই একমাত্র সম্পদ যা আমার মেয়েদের কাজে লাগবে,' যোগ করেন আবুল হোসেন।

মহাখালী সাততলা বস্তির চাঁদনী আক্তারের (২১) অবস্থাও এমন। ২০১৮ সালে তার মা চিকিত্সার অভাবে মারা যান। ভয়াবহ দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা চাঁদনী তখন নার্স হতে চেয়েছিলেন।

নার্সিংয়ে বিএসসিতে ভর্তি হবেন বলে কয়েকটি বই কিনেছিলেন। কিন্তু ২০২১ সালে আগুনে তাদের বাড়ি পুড়ে যায়। বই পুড়ে যায়, পুড়ে যায় স্বপ্নও।

তিনি এখন টঙ্গী সরকারি কলেজে বিএ তে ভর্তি হয়েছেন। চেষ্টা করছেন তার ছোট ২ বোনকে পড়াতে।

চাঁদনী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি তো পারিনি। চাই বোনদের স্বপ্ন পূরণ হোক।'

একটি এনজিওতে ফিল্ড কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে মাসে ৫ হাজার টাকা আয় করেন চাঁদনী। ৩টি প্রাইভেট টিউশন করে আরও ৩ হাজার টাকা আয় করেন। বোনদের পড়াশোনা করাতে তিনি এই টাকা খরচ করেন।

চাঁদনীর বৃদ্ধ বাবা আবদুর রহিম একজন মিস্ত্রি হলেও রোজগার নেই বললেই চলে। এদিকে, পরিবারটির ওপর মাসিক ৫ হাজার টাকা সুদসহ এক লাখ টাকা ঋণের বোঝা আছে।

আবদুর রহিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায়ই আত্মীয়দের কাছে সাহায্য চাই, কিন্তু পাই না।'

কড়াইল বস্তির মো. শান্ত মিয়া (১৮) রূপনগর সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়েন। আগে বাবার পান-সিগারেটের দোকানে কাজ করতেন।

শান্ত একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর তার ছোট ভাইকে মাদ্রাসা ছাড়তে হয়। ৬ সদস্যের পরিবারকে বাঁচাতে ছোট ভাইকে বসতে হয় দোকানে।

শান্ত ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চাকরি খুঁজছি। আমি চাই না আমার পড়াশোনার খরচের বোঝা বাবার ওপর পড়ুক।'

বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শান্তর ইচ্ছা মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বা নার্সের চাকরি। তিনি মনে করেন, এমন কাজ পেলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত বস্তিবাসীর উপকারে আসতে পারবেন।

কড়াইল বস্তি উন্নয়ন সমিতির সভাপতি মাওলানা আবদুস সোবহান ডেইলি স্টারকে জানান, এ বস্তিতে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার আছে। এখানে ২০টি এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। কিন্তু কোনো কলেজ নেই।

তিনি বলেন, 'এখানকার কয়েকজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। পড়াশোনার খরচ তাদের নিজেকে জোগাড় করতে হয়। আয় কমে যাওয়ায় অধিকাংশ অভিভাবক সন্তানদের পড়াশোনা করাতে রাজি হয় না।'

'তবে, এখন এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। অনেক অভিভাবক এখন তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করতে চান,' যোগ করেন তিনি।

ইউনিসেফের কিশোর ও স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষা কর্মসূচির শিক্ষা ব্যবস্থাপক শিশু-শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ইকবাল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমানে, বস্তির শিশুদের উচ্চশিক্ষার বিষয়ে কর্মসূচি নেই। মাধ্যমিক শিক্ষা চালিয়ে যেতেই তাদের অনেক চ্যালেঞ্জে পড়তে হচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'যেহেতু তাদের প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ কম ও শিক্ষার খরচ অনেক বেশি, তাই শুধু যারা অতি আগ্রহী ও নিজেরা উপার্জন করতে পারেন অথবা অন্য সংস্থার বৃত্তি পান, তারাই শুধু পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন।'

আরও বলেন, 'আমরা বস্তির শিক্ষার্থীদের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা সহজ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি, যেন তারা তাদের মতো করে সময় নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। এছাড়াও আমরা মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার চ্যালেঞ্জ কমাতে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands. 

1h ago