টাঙ্গাইলে টিলার লালমাটি যাচ্ছে ইটভাটায়, ফিকে হয়ে আসছে সবুজ

খননযন্ত্র দিয়ে চলছে টিলা কাটার কাজ। সম্প্রতি মির্জাপুরের তরফপুর এলাকা থেকে তোলা। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

টাঙ্গাইলের মধুপুর, ঘাটাইল, সখীপুর, মির্জাপুর ও কালিহাতি উপজেলার ‍বিভিন্ন এলাকায় পরিবেশ আইন অমান্য করে খননযন্ত্র দিয়ে টিলার মাটি কেটে ফেলার যে ধারা অব্যাহত ছিল, তা এখনো চলছে।

স্থানীয়রা বলছেন, টিলাকাটা মাটি নেওয়া হচ্ছে ইটভাটায়, ব্যবহৃত হচ্ছে সড়ক নির্মাণ ও প্রশস্তকরণ এবং নিচু জমি ভরাটের কাজে। কাঁচা টাকার লোভে স্থানীয় লোকজন নিজেদের ব্যক্তি মালিকানাধীন টিলাও কাটতে শুরু করেছেন। ফলে দিনে দিনে টিলাশূন্য হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে পুরো টাঙ্গাইল জেলা। এতে উজাড় হচ্ছে সবুজ, ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ, হুমকিতে পড়েছে জীববৈচিত্র্য

অথচ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১২-এর ৬ ধারা) অনুযায়ী প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট টিলা ও পাহাড় কাটা বা নিধন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

টাঙ্গাইলের স্থানীয়দের পাশাপাশি পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, টিলা কাটা নিয়ে নিয়মিত গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হচ্ছে, চলছে প্রতিবাদ, জেলার আইন শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন কমিটির সভাতেও চলছে আলোচনা। মাঝেমধ্যে দুয়েকটি অভিযান পরিচালনা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এর কোনোকিছুই টিলার ওপর অত্যাচার থামাতে পারেনি।

সম্প্রতি জেলার মধুপুর, ঘাটাইল, সখীপুর, মির্জাপুর ও কালিহাতি  উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব জায়গার মাটি ব্যবসায়ীরা সরকারি জমির পাশাপাশি ব্যক্তিগত জমির টিলাও কাটছেন।

ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

ঘাটাইলের মানবাধিকারকর্মী ও স্কুলশিক্ষক মাসুম মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই উপজেলার প্রায় অর্ধেকই টিলা অঞ্চল। প্রকাশ্যেই চলছে এসব টিলা কাটা। টিলার মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়, ব্যবহার করা হচ্ছে নিচু জমি ভরাট এবং রাস্তা তৈরির কাজে। টাঙ্গাইল-জামালপুর মহাসড়ক প্রশস্তকরণের কাজেও ব্যবহার হচ্ছে এসব টিলাকাটা লাল মাটি।'   

তিনি জানান, উপজেলার নলমা, ছনখোলা, গারোবাজার, কাজলা, সাগরদিঘী এবং টেপুকুশারিয়া এলাকায় চলছে নির্বিচারে টিলা কাটা। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়াতেই চলছে প্রকৃতি ধ্বংসের এই মহোৎসব।

অবশ্য ঘাটাইলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিয়া চৌধুরীর দাবি, টিলা কাটার খবর পেলেই তারা সেখানে অভিযান চালান। জেল-জরিমানা করা হয়। এতে টিলা কাটার কাজ কিছুদিন বন্ধ থাকলেও আবার শুরু হয়। অনেকে অভিযান এড়াতে রাতের বেলায় এই কাজ করেন।

ঘাটাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম জানান, সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়ের করা মামলায় টিলাকাটা মাটি বোঝাই ৮টি ট্রাক আটক করে এর চালকদের আদালতে চালান দেয়া হয়।

তবে টাঙ্গাইলের আদালত পরিদর্শক তানভীর অহম্মেদের ভাষ্য, পরিবেশ আইনের জামিনযোগ্য ধারায় মামলা দেওয়ার কারণে গ্রেপ্তারের দিনেই জামিন হয়ে যায় ওই চালকদের।

সখীপুরের কাকড়াজান ইউনিয়নের হামিদপুরে দেখা যায়, টিলাকাটা মাটি ট্রাকে করে ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদিকে মাটিবাহী ভারী ট্রাকের চলাচলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক।

মির্জাপুর উপজেলার কদমা এলাকায় দেখা যায়, মাটি ব্যবসায়ীরা টিলার ওপর ব্যক্তিমালিকানাধীন  একটি বাড়ি কিনে সেখান থেকে মাটি কেটে ইটভাটাসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠাচ্ছেন। আইনে আছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলাও বিনা অনুমতিতে কাটা বা এর শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।  

পরিবেশ অধিদপ্তরের টাঙ্গাইল কার্যালয়ের উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, 'পরিবেশ আইন অনুযায়ী পাহাড় কাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে ২ লাখ টাকা জরিমানা এবং ২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে।'

তিনি জানান,  টিলা কাটার অভিযোগে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে জেলার মধুপুর, ঘাটাইল, কালিহাতী ও মির্জাপুর থানায় সম্প্রতি পৃথক ৪টি মামলা দায়ের করেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দের ভাষ্য, কতৃপক্ষ জানে যে কারা টিলা কাটছে। সেক্ষেত্রে তাদের নামে মামলা না দিয়ে মাটির ট্রাক আটকে বা ড্রাইভারদের গ্রেপ্তার করার কারণ কি? এমন দয়সারা মনোভাব থাকলে এখনো যে অল্পসংখ্যক টিলা অক্ষত আছে, সেগুলোও বাঁচানো যাবে না।'

তিনি আরও বলেন,  'স্থানীয় প্রশাসনও এই অপূরণীয় ক্ষতির দায় এড়াতে পারে না।'

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা (ইএসআরএম) বিভাগের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলার মধ্যভূমিতে একসময় প্রচুর পরিমাণে ছোট ও মাঝারি আকারের টিলা ছিল। গত কয়েক দশকে ২ জেলার পাহাড়ি ভূমির ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিকীকরণ এবং নগরায়ন সম্প্রসারণের কারণে এর রূপান্তর ঘটছে।

গবেষণা তথ্য অনুসারে, ৩ দশক আগেও এই ২ জেলার টিলাগুলো প্রাকৃতিক শাল গাছে পরিপূর্ণ ছিল এবং বিভিন্ন সাপ-পাখিসহ অসংখ্য বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল ছিল। এখন এর প্রায় সবই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে ভূমিধসসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি।

Comments

The Daily Star  | English

US welcomes Bangladesh election plan

The US yesterday welcomed plans by Bangladesh's interim leader to hold elections next year or in early 2026

1h ago