মিরপুর: মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন

মিরপুরে হ্যান্ডমাইকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

'সকালবেলা আমি লে. সেলিমকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ১২ নম্বর সেকশনে যাই। সেকশনের মাঝামাঝি একটি উঁচু জায়গায় ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক কথাবার্তা বলি। লে. সেলিমও তখন আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। এরমধ্যে সৈনিকদের খাবার নিয়ে ট্রাকও এসে পৌঁছায়। এরপর আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমার ক্যাম্পের দিকে রওনা হই। লে. সেলিম থেকে যান মোর্শেদের সঙ্গে। আমি ফিরে আসার আধা ঘণ্টা পর আনুমানিক ১১টার দিকে চারদিকের বিভিন্ন বাড়িঘর থেকে একযোগে মোর্শেদের নেতৃত্বাধীন সেনা ও পুলিশের ওপর বিহারিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়।

এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ফলে পুলিশ ও সেনারা হতাহত হয়। তারা পাল্টা আক্রমণের তেমন কোনো সুযোগই পায়নি। লে. সেলিম, সুবেদার মোমেন, নায়েক তাজুলসহ অনেকে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। কোম্পানি কমান্ডার হেলাল মোর্শেদ আহত হন। তার কাঁধে গুলি লাগে।'

'এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য স্বাধীনতার প্রথম দশক' বইয়ে মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর দখলের দুঃসাহসিক সেই অভিযানের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেই। 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরাজয় হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর। কিন্তু আত্মসমর্পণের পরও পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল। ঢাকায় আত্মসমর্পণের ১ সপ্তাহ পর্যন্ত যুদ্ধ চলার পর ২৩ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় কুমিল্লার হোমনা। কিন্তু একটি এলাকা তখনো পাকিস্তানি বাহিনী ও বিহারিদের হাতে পুরোপুরি অবরুদ্ধ। সেই এলাকা হচ্ছে ঢাকার মিরপুর।

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি এক বিশেষ সামরিক অভিযানের পর ৩১ জানুয়ারি ১২ নম্বর সেকশনের ডি ব্লক ঈদগাহ মাঠে আত্মগোপনকারী পাকিস্তানি সেনা, বিহারি, রাজাকার, আলবদরদের অস্ত্রসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্ত হয় মিরপুর।

যে কারণে মিরপুরে বিশেষ অভিযান

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পুরো দেড় মাস কেটে গেছে ততদিনে। এরইমধ্যে ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন বঙ্গবন্ধু। ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণও করেছেন তিনি। কিন্তু তখনো মুক্ত হয়নি মিরপুর।

পাকিস্তানি বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করলেও আত্মসমর্পণ করেনি তাদের দোসর বিহারি, মিলিশিয়া, রাজাকার ও আল বদররা। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় ২০ হাজার বিহারিকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে গঠন করে সিভিল আর্মড ফোর্স (সিএফএফ) নামের একটি বাহিনী, যাদের অধিকাংশই ছিল মিরপুরের বাসিন্দা। তখন কোনো পাকিস্তানি সেনা দলছুট হয়ে পড়লে আশ্রয় নিত বিহারিদের কাছে। এসব কারণে মিরপুর ছিল এক ভয়াল জনপদ। সেখানে মুক্তিকামী বাঙালিদের প্রবেশ মানেই নিশ্চিত মৃত্যু।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় বাহিনীর ১০ বিহার রেজিমেন্টকে মিরপুরে মোতায়েন করা হয়। জানুয়ারি মাসে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকীকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হলে তিনি শর্ত দিয়ে বলেন, আগে মিরপুরে থাকা বিহারিদের অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। এরপর তার বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করবে। এরপরই অবরুদ্ধ মিরপুরকে মুক্ত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

মিরপুরকে মুক্ত করার জন্য যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গাড়ি। ছবি: সংগৃহীত

সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল এম এ জি ওসমানী লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহর সঙ্গে বৈঠক করেন। সিদ্ধান্ত হয়, বিহারি রাজাকার ও তাদের সহযোগীদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের একটি দল মিরপুর ১২ নম্বরে যাবে। এ সময় গুরুত্বপূর্ণ বিহারি নেতাদের একটি তালিকাও তৈরি করা হয়। ২৮ জানুয়ারি জেনারেল ওসমানী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীকে সেনা দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করার মৌখিক নির্দেশ দেন।

জেনারেল ওসমানী মেজর মইনকে আরও বলেন, ২৯ জানুয়ারির মধ্যে এক কোম্পানি সেনাকে যেন মিরপুরে পাঠানো হয়। পুলিশ এবং ভারতীয় বিহার রেজিমেন্টের সেনারা তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করবে। মেজর মইন তখন তার অধীনে থাকা ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোর্শেদকে কোম্পানির সেনাদের নিয়ে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে মিরপুর যাওয়ার আদেশ দেন। সিদ্ধান্ত হয়, ৩০ জানুয়ারি মেজর মইন এলেই অভিযান শুরু হবে।

২৯ জানুয়ারি ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্বে তার কোম্পানির সেনারা মিরপুর ১ নম্বরের শাহ আলী মাজার সংলগ্ন স্কুল ও ২ নম্বরের বায়তুল আমান হাউজ নামের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে অবস্থান নেন।

হাবিলদার ওয়াজিদ আলীর নেতৃত্বে এক প্লাটুন সেনাকে মিরপুর ১১ নম্বর পুলিশ বক্সের সামনে মোতায়েন করা হয়। এরপর বিহার রেজিমেন্টের সেনারা হেড কোয়ার্টারে ফিরে যায়।

কী হয়েছিল অভিযানে

৩০ জানুয়ারি সকালে মিরপুরের অ্যাডিশনাল এসপি জিয়াউল হক লোদীর নেতৃত্বে ৩০০ পুলিশ মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে থাকা সেনাদের সঙ্গে যোগ দেয়। উদ্দেশ্য ছিল  তল্লাশি করে চিহ্নিতদের গ্রেপ্তার করা।  এ কাজে সেনারা তাদের সহযোগিতা করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বেশ কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে কয়েকজনকে আটক করা হয়।

মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম। ছবি: সংগৃহীত

অভিযানের এক পর্যায়ে সকালে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদকে পুরো দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে রওনা হন।

সকাল ১১টার দিকে আচমকা সশস্ত্র বিহারিরা বাড়িঘর থেকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। বিহারিদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও হ্যান্ড গ্রেনেডের হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়ে সেনা ও পুলিশ। কারণ তারা হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। বেশিরভাগ সেনা ও পুলিশ হতাহত হয়। মুহূর্তেই শহীদ হন সুবেদার মোমেন, নায়েক তাজুলসহ বেশ কয়েকজন সেনা। কাঁধে গুলি লেগে আহত হন কোম্পানি কমান্ডার হেলাল মোর্শেদ।

গুলি লাগে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম কামরুল হাসানের শরীরেও। আহত অবস্থাতেও সেলিম কামরুল হাসানের নেতৃত্বে সেনারা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সময় গায়ের শার্ট খুলে ক্ষতস্থান বেঁধে নেন লেফটেন্যান্ট সেলিম। সহযোদ্ধারা তাকে, 'স্যার, আপনি আমাদের ফেলে যাবেন না' বলে অনুরোধ করলে লেফটেন্যান্ট সেলিম বলেন, 'আমার গায়ে এক বিন্দু রক্ত থাকতে তোমাদের ফেলে যাব না।' যদিও ব্যাপক রক্তক্ষরণে এক পর্যায়ে তিনি শহীদ হন।

সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম কামরুল হাসান। ছবি: সংগৃহীত

মিরপুর ১২ নম্বরের পানির ট্যাংকের ফাঁকা জায়গায় ছিল মিরপুরের অ্যাডিশনাল এসপি জিয়াউল হক লোদীর নেতৃত্বে পুলিশের একটি বড় দল। সকাল ১১টার দিকে বিহারিরা একযোগে গুলিবর্ষণ শুরু করলে দ্রুত ১২ নম্বর প্লাটুনের কমান্ডার মোখলেসুর রহমান তার প্লাটুন নিয়ে ছুটে আসেন। তিনি দেখতে পান জিয়াউল হক খান লোদীসহ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর শতাধিক সেনার মরদেহ পড়ে আছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিহারিরা ১২ নম্বর প্লাটুনকে দেখতে পেয়ে ফের গুলিবর্ষণ শুরু করে।

বিহারিরা মিরপুর সাড়ে ১১ সেকশনে অবস্থান নেওয়া হাবিলদার বারকীর প্লাটুনের ওপরও অতর্কিত হামলা চালায়। শুরুতেই হাবিলদার বারকীসহ সেনারা দ্রুত খাল সাঁতরে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন। প্রতিরোধের ফলে বিহারিরা পুলিশ ফাঁড়ির দখল নিতে পারেনি। এক পর্যায়ে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকে। 

বিহারিদের আক্রমণের খবর শুনে মেজর মইনুল হোসেন তার অধীনস্থ মেজর মতিউরের নেতৃত্বাধীন ব্রাভো কোম্পানিকে সঙ্গে নিয়ে ১২ নম্বর সেকশনের উল্টো দিকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কাছে অবস্থান নেন। এরপর তারা হাবিলদার বারকীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বিহারিরা মেজর মইনের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে।

এক পর্যায়ে মিরপুর এক্সচেঞ্জ থেকে সাড়ে ১১ এর পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন দিলে হাবিলদার বারকীর সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাদের। হাবিলদার বারকী তখন মইনকে অবস্থা সম্পর্কে জানিয়ে দ্রুত আরও গোলাবারুদ আনার অনুরোধ করেন।

বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

 বিকেল পর্যন্ত চলা ব্যাপক গোলাগুলির এক পর্যায়ে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ওপর থেকে ভারি মেশিনগান ও গোলা হামলা চালানো হয় বিহারিদের ওপর। সন্ধ্যার পর শুরু হয় সেনাবাহিনীর মর্টারের গোলা হামলা। রাত বাড়ার পর শুরু হয় বিহারিদের থেমে থেমে গুলিবর্ষণ। সারারাত সেনাবাহিনীর সঙ্গে খণ্ড যুদ্ধ চলে বিহারিদের।

৩১ জানুয়ারি ভোরে মেজর মইন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ভারি অস্ত্রসহ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের পুরো ব্যাটেলিয়ন মিরপুরে নিয়ে আসেন। এর আগে রাতের মধ্যেই সব বিহারি যুবক পালিয়ে যায়।

এদিন সকালে কর্নেল শফিউল্লাহ ও কর্নেল খালেদ মোশাররফ মিরপুরে আসেন। বৈঠকে তারা বুঝতে পারেন, মিরপুর ১-১২ নম্বর সেকশনকে পুরোপুরি শত্রুমুক্ত করতে হলে ব্যাপক সেনা প্রয়োজন। তাই চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে মিরপুরের ১,২ ও ৬ নম্বর সেকশন শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলকে দেওয়া হয় ১০, ১১ ও ১২ নম্বর সেকশন শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব।

এরপর প্রতিদিন সকালে কারফিউ জারির মাধ্যমে সেনা মোতায়েন করে সেকশনের লোকদের যার কাছে যেমন অস্ত্র আছে তা উন্মুক্ত স্থানে এনে জমাদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। মিরপুরকে পুরোপুরি জনশূন্য করে এভাবে টানা ১০ দিন তল্লাশির পর শেষ পর্যন্ত মিরপুরকে শত্রুমুক্ত করা হয়। এই তল্লাশি অভিযানে জব্দ করা হয় প্রায় ১১ ট্রাক অস্ত্র।

মিরপুরমুক্ত করার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম কামরুল হাসানসহ ৪১ জন সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং মিরপুরের অ্যাডিশনাল এসপি জিয়াউল হক লোদীসহ শতাধিক পুলিশ সদস্য। যদিও ৪-৫ জন ছাড়া তাদের কারোরই মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

 

তথ্যসূত্র:

এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য / মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম

স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধ ও আমার সামরিক জীবন/ এইচ এম আব্দুল গাফ্‌ফার

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

8h ago