সাদা কাগজ কি আসলেই চোখের জন্য ক্ষতিকর

সাদা কাগজ কি আসলেই চোখের জন্য ক্ষতিকর
ছবি: লিংকডইন

'ছাপানো কাগজ অনেক বেশি সাদা হলে তা চোখের জন্য ক্ষতিকর', বলে সম্প্রতি এক মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। চলতি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা হওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এসব কথা বলেন।

অনেক বেশি সাদা কাগজ আসলেই চোখের জন্যে ক্ষতিকর কি না কিংবা ক্ষতিকর হলে সেক্ষেত্রে বইয়ের কাগজ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়েই আজকের আলোচনা।

কাগজের উজ্জ্বলতা

১৯১৪ সালের ২১ মার্চ অধ্যাপক এল আর ইনগারসোল-এর, 'কাগজের উজ্জ্বলতা পরিমাপের উপায়' শীর্ষক এক সচিত্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। গ্ল্যারিমিটার নামের যন্ত্রের সাহায্যে সেটি পরিমাপ করা হয়। সেখানে বলা হয় কাগজের ঔজ্জ্বল্য, বা প্রতিফলিত আলো চোখের তারার সংকোচন ঘটাতে পারে। যার ফলে দৃষ্টিশক্তি ক্ষয় এবং চোখের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। গ্ল্যারিমিটার এই ঝলকানির পরিমাণ পরিমাপ করে। আর ঝলকানির মাত্রার ওপর ভিত্তি করে পাঠ্য বইয়ে ব্যবহৃত কাগজের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়।

পরীক্ষাটিতে দেখা যায়, অমসৃণ সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতার মাত্রা বেশ কম ছিল। আবার সেই একই সংবাদপত্র, ক্যালেন্ডারিং রোল বা মসৃণ করার যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে নেওয়ার পর সেটির ঔজ্জ্বল্যের মাত্রা ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে কালো এবং রঙিন কাগজে একই ফিনিশের সাদা কাগজগুলোর তুলনায় ঝলকানির মাত্রা অনেক বেশি ছিল। অন্যদিকে খয়েরি সোলিও কাগজের ক্ষেত্রে এই মাত্রা সবচেয়ে বেশি ছিল।  

ডক্টর লুডভিগ কোটেলম্যান 'স্বাস্থ্যকর' স্কুল বই সম্পর্কে বলেছেন, বইগুলোতে ব্যবহৃত কাগজ হলুদাভ সাদা হওয়া উচিত, যেহেতু খাঁটি সাদা অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে থাকে। আর সেটি খুব চকচকে হওয়া উচিত নয়। কাগজটিতে যতটা সম্ভব কম কাঠের পাল্প থাকা এবং পর্যাপ্ত পুরু হওয়া উচিত।

স্কুলের চোখের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত ফরাসি বই, 'হিজিইয়েন অকুলেইর দিজ ইকোল'-এ বলা হয়েছে, অতিরিক্ত সাদা, নীলাভ, ধূসর বা চকচকে কাগজগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। এর কারণ সেগুলোতে আলোর প্রতিফলন বেশি হয় এবং স্পষ্টতার পরিমাণ অপর্যাপ্ত থাকে।

নিউইয়র্কের অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন প্রিন্সিপাল অব পাবলিক স্কুলের দ্য কমিটি অন চিলড্রেনস ওয়েলফেয়ার ১৯০৮ সালে চোখের ওপর চাপ কমাতে একটি উপদেষ্টা বোর্ডের সঙ্গে চক্ষু বিশেষজ্ঞদের একটি সম্মেলনের আয়োজন করে।

ওই সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, 'এখন থেকে শিশুদের দেওয়া পাঠ্যপুস্তকে কোনো ধরনের মসৃণ প্রলেপ দেওয়া কাগজের অনুমোদন দেওয়া হবে না। কারণ এই জাতীয় কাগজের উজ্জ্বলতা তাদের চোখের জন্য ক্ষতিকর।'

শিক্ষা বোর্ডের কাছে ওই প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করার সময় কমিটিটি জানায়, 'মায়োপিয়া বা ক্ষীণ দৃষ্টির মাত্র ৫ শতাংশ অপ্রতিরোধ্য এবং অনিয়ন্ত্রিত। মায়োপিয়ার বেশিরভাগ কারণই স্কুল থেকে হওয়া চোখের ওপর চাপের সঙ্গে কম-বেশি সরাসরিভাবে জড়িত। মায়োপিয়া বিকাশের দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় স্কুলের বইগুওলোতে ব্যবহৃত কাগজের ধরন।' 

ছবি: রয়টার্স

আমেরিকান স্কুল হাইজিন অ্যাসোসিয়েশনের ১৯১১ সালের স্কুল বইয়ের  স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন প্রতিবেদন অনুসারে, পাঠ্যপুস্তকের কাগজের বিষয়ে কমিটি যা বলেছে তা হলো, কাগজটি চকচকে এবং অস্বচ্ছ হওয়া যাবে না। অর্থাৎ চাকচিক্যবিহীন হতে হবে। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার রুক্ষতা চাকচিক্যের ভাব কমিয়ে আনতে পারলেও পরিষ্কার সাদা কাগজের ক্ষেত্রে সেটি হওয়ার সম্ভাবনা কম। 

স্কুলের বইয়ের কাগজ সাদা বা সামান্য রঙিন হওয়া উচিত কি না, সে সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরীক্ষামূলক প্রমাণগুলো বলছে, কালো রঙ, সামান্য রঙিন কাগজের তুলনায় সাদার ওপর বেশি সুস্পষ্ট ও সহজপাঠ্য। তবে ক্লিনিকাল দিক বিবেচনা করলে সামান্য রঙিন কাগজকেই বেশি সুবিধাজনক বলে মনে করা হচ্ছে।

ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্সের অকুলিস্ট সাবকমিটির প্রতিবেদনের উপসংহারটি ছিলো এমন, স্কুলের শিশুদের মধ্যে কিছু গুরুতর চোখের ত্রুটি তাদের ব্যবহৃত বইগুলোর কারণে হয়ে থাকে। এ ছাড়া তাদের সুনির্দিষ্ট সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে, কাগজ যেন চকচকে না হয়ে শক্ত, মসৃণ এবং অস্বচ্ছ হয়। সেটি সাদা বা ক্রিম রঙের এবং অমসৃণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। 

তবে কাগজ সংক্রান্ত সবগুলো বিবেচনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটি কম চকচকে হওয়া উচিত।

খুব বেশি সাদা কাগজে কালো অক্ষর

অনেক বেশি সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে (পটভূমিতে) গাঢ় কালো কালির লেখা চোখের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এর কারণ সাদা রঙের উজ্জ্বলতা সাধারণতই বেশি থাকে। যেখানে কালো রংটির উজ্জ্বলতা নেই বললেই চলে। রঙের উজ্জ্বলতার এই অতিরিক্ত পার্থক্য লেখা পড়ার সময় চোখকে অতিরিক্ত উদ্দীপিত করে। এর ফলে চোখ উজ্জ্বলতার পার্থক্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কঠোর পরিশ্রম করে। যা চোখকে ক্লান্ত করে ফেলে এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য কোনো লেখা অনেক বেশি সাদা পটভূমিতে গাঢ় কালো অক্ষরে পড়ার কারণে তা পাঠকের চোখের ওপর চাপের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তাই অতিরিক্ত সাদা কাগজে যদি কালো লেখাটিও অনেক বেশি গাঢ় হয়, তাদের মধ্যকার কনট্রাস্ট বা বৈপরীত্যের কারণে এ ধরনের ঘটনাটি ঘটে। তাই ২ মেরুর ২টি রঙের বদলে কম কনট্রাস্ট বা বৈপরীত্যের রঙ ব্যবহারেরও পরামর্শ দেওয়া হয়। সেটি বইয়ের ক্ষেত্রে হোক কিংবা আপনার ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ক্ষেত্রে হোক।

একটি উদাহরণ এই ধারণাটিকে আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। যখন আমরা একটি অন্ধকার ঘরে একটি উজ্জ্বল আলো চালু করি। আলোর অবস্থার এই ধরনের তীব্র পরিবর্তন আমাদের চোখের ওপর তীক্ষ্ণ চাপ তৈরি করে। কিন্তু আমরা যদি একটি অন্ধকার ঘরে একটি ম্লান আলো জ্বালাই, তাহলে আমাদের চোখ পরিবর্তনের সঙ্গে সহজে খাপ খাইয়ে নেয়। এর কারণ আমাদের রেটিনা সেখানে তীব্র কনট্রাস্ট বা বৈপরীত্যের কারণে অতিরিক্ত উদ্দীপিত হয় না।

সেক্ষেত্রে চাইলে কালো অক্ষরের পরিবর্তে একটি সাদা পটভূমিতে গাঢ় ধূসর অক্ষরও ব্যবহার করা যেতে পারে। যাতে উজ্জ্বলতার পার্থক্য ততটা বেশি না হয়। যা রেটিনাকে অতিরিক্ত উত্তেজিত হওয়া থেকে রক্ষা করে এবং পাঠকরা আরও বেশি সময় ধরে পড়তে পারে। তাই ভালো পঠনযোগ্যতার জন্য সুষম মাত্রায় কনট্রাস্ট বা বৈপরীত্যের প্রয়োজন।

তবে মুদ্রিত কোনো কাগজের তুলনায় কোনো স্ক্রিন যেমন- ফোন, কম্পিউটারের সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে কালো লেখার বৈসাদৃশ্য সাধারণত অনেক বেশি হয় এবং স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। সাধারণত ঘরের ভেতরে সাধারণ আলোয় সাদা কাগজ একটি ইলেকট্রনিক ডিসপ্লের মতো ততটা উজ্জ্বল হয় না। তবে বাইরের উজ্জ্বল আলোয় অতিরিক্ত সাদা কাগজ বেশ উজ্জ্বল এবং চোখের ওপর প্রভাব বেশি ফেলে। 

অন্যান্য রঙের কাগজে পড়ার প্রভাব

কার্নেগী মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা যায়, নির্দিষ্ট কিছু রঙের পটভূমির ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত এবং সুস্থ মানুষের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। শীতল ব্যাকগ্রাউন্ডের রং যেমন, নীল, ধূসর এবং সবুজের তুলনায় উষ্ণ পটভূমির রং যেমন, পীচ, কমলা এবং হলুদ রং পঠন ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে। 

তবে ভেরোনিকা নামের একটি ওয়েবসাইট তাদের 'কালারড পেপার অ্যান্ড দ্য রিডাবিলিটি অব টেক্সট' নামের একটি পরীক্ষায় বলছে, হালকা হলুদ এবং হালকা নীল রঙের কাগজে পড়া সহজ। এগুলোয় প্রায় সব ধরনের আলোতেই সহজেই পড়া যায় বলে জানিয়েছেন তারা। 

 

তথ্যসূত্র: জেএসটিওআর, রিসার্চগেট, ইউএক্স মুভমেন্ট, সিএস সিএমইউ, ন্যাচার ডট কম, পারকিনস স্কুল ফর দ্য ব্লাইন্ড
 

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands. 

1h ago