‘জেনারেল উইন্টার’ যে বার্তা দিলো পুতিনকে

জেনারেল উইন্টার
ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

অনেক সমরবিদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার কোনো দেশের সেনাবাহিনীর কাছে হারেননি। হেরেছিলেন প্রকৃতির হাতে।

১৯৪১ সালের ২২ জুন 'অপারেশন বারবারোসা'র মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করতে গিয়ে জার্মান বাহিনীর পূর্ব কমান্ডের প্রায় সাড়ে ৭ লাখ সেনা কাবু হয়েছিলেন প্রবল শীতের কামড়ে।

সে বছর ২৭ নভেম্বর কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল এডওয়ার্ড ভাগনার নাৎসি বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তার কাছে লিখেছিলেন, 'মনে হয়, আমাদের যুদ্ধ হচ্ছে তীব্র শীতের বিরুদ্ধে।'

শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই নয়, এরও অনেক আগে ১৮১২ সালের ২৪ জুন প্রায় ৬ লাখ ১০ হাজার জনবলের বিশাল বাহিনী নিয়ে রাশিয়া দখল করতে গিয়েছিলেন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। গ্রীষ্মের শুরুতে অভিযান চালালেও সেখানে নাস্তানাবুদ হয়ে তিনি ফিরেছিলেন এক লাখ মানুষ নিয়ে।

সেই যুদ্ধের এক রুশ সেনা ও সামরিক ইতিহাস বিশ্লেষক ডেনিস দাভিদভ লিখেছিলেন, রাশিয়ার 'মনোরম আবহাওয়া'সহ অন্যান্য কারণে ফরাসি বাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছিল।

নেপোলিয়ন তার স্ত্রী মারি লুইকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, 'শীতের কারণেই এমন বিপদ হয়েছিল। আমরা রুশ আবহাওয়ার হাতে পরাজিত হয়েছিলাম।'

জেনারেল উইন্টার
তীব্র শীতে পরিখা পাহারায় ইউক্রেনীয় সেনা। ছবি: রয়টার্স

আরও আগে, ১৭০৭ সালে প্রতিবেশী রাশিয়ায় অভিযান চালিয়েছিলেন সুইডেনের রাজা দ্বাদশ চার্লস। 'গ্রেট নর্দান ওয়ার' নামে পরিচিত সেই যুদ্ধে তিনি ৩৫ হাজার সেনা নিয়ে রাশিয়ার এসে ২ বছর পর ফিরেছিলেন ১৯ হাজার সেনা নিয়ে।

সমরবিদদের কাছে রাশিয়ার শীত এতই আলোচিত যে, এই শীতের নাম তারা দিয়েছেন 'জেনারেল উইন্টার'।

সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে রাশিয়ায় শীতের দাপট হয়তো কিছুটা কমেছে। তবে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী ইউক্রেনে পরাশক্তি রাশিয়ার 'বিশেষ সামরিক অভিযান' চলাকালে সেই শীত বা 'জেনারেল উইন্টার'র প্রসঙ্গ আবার আলোচনায় আসে।

অনেকেই ভেবেছিলেন, এই শীতে ইউক্রেনীয় বাহিনী তথা ইউক্রেনের বর্তমান সরকারের পতন হতে পারে। সেই লক্ষ্যে রুশ বাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করে। নির্বিচারে হামলা চালিয়ে সাধারণ জনগণের ভোগান্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

তারপরও, রুশ বাহিনীর বিজয়ের পরিবর্তে বিপর্যয়ের সংবাদ পেয়েছে বিশ্ববাসী।

নিউ ইয়ার উদযাপনের সময় ইউক্রেনীয় বাহিনী রাশিয়ার দখল থাকা দোনেৎস্ক অঞ্চলের মাকিভকা শহরে রুশ সেনাদের অস্থায়ী ছাউনিতে হামলা চালায়।

গতকাল সোমবার রুশ সংবাদমাধ্যম দ্য মস্কো টাইমস জানিয়েছে, সেই হামলায় '৮৯ সেনা' নিহত হয়েছেন বলে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে। ইউক্রেনের দাবি নিহতের সংখ্যা অন্তত '৪০০ জন'।

ইউক্রেনযুদ্ধে এক সঙ্গে এতো বেশি রুশ সেনা নিহতের ঘটনা এই শীতেই ঘটল। এই ঘটনায় পুতিনপন্থি ব্লগাররা রুশ জেনারেলদের বিচারের দাবি করেছেন বলে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।

সেদিন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, মস্কোর দাবি মাকিভকা শহরে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে দোনেৎস্কের উত্তরাঞ্চলীয় ক্রামাতোরস্ক শহরের প্রশাসনিক এলাকায় রুশ হামলায় '৬০০-র বেশি' ইউক্রেনীয় সেনা নিহত হয়েছেন।

জেনারেল উইন্টার
রুশ বাহিনীকে প্রতিরোধে প্রস্তুত ইউক্রেনীয় সেনা। ছবি: রয়টার্স

প্রতিবেদন অনুসারে, মস্কোর সেই দাবিকে 'অপপ্রচার' বলে আখ্যা দিয়েছে কিয়েভ।

এ প্রসঙ্গে দ্য মস্কো টাইমস জানিয়েছে, গত শনিবার ক্রামাতোরস্ক শহরে এএফপির সাংবাদিক মধ্যরাতে অন্তত ৪টি বড় বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন।

তবে ঠিক কোন সময় হামলা চালানো হয়েছিল সে বিষয়ে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কিছু জানায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বার্তা সংস্থা সংস্থা রয়টার্স জানায়, রুশদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে খোলা জায়গায় পড়েছে।

এর আগে, রুশ অর্থোডক্স গির্জার অনুসারীদের কাছে 'বড়দিন' হিসেবে বিবেচিত ৭ জানুয়ারি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ৬ ও ৭ জানুয়ারি ৩৬ ঘণ্টার একতরফা যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। এ ঘোষণাকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি 'প্রহসন' হিসেবে মন্তব্য করেন।

যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আগের দিন গত ৫ জানুয়ারি রুশ সংবাদমাধ্যম আরটির প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যাডলি ইনফ্যানট্রি যুদ্ধযান ও জার্মানির মার্ডার ইনফ্যান্ট্রি যুদ্ধযান ইউক্রেনে পাঠানোর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নিশ্চিত করেছে।

গত ৪ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ যৌথ বিবৃতিতে এটি নিশ্চিত করেছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি এ বিষয়ে ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশিক্ষণ দেবে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

ধারণা করা যায়, পশ্চিমের এসব সামরিকযান প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক উন্নত হবে।

এ ছাড়াও, গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসের বরাত দিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ২ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে থাকছে ২২৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা।

যেসব ড্রোন দিয়ে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ জরুরি সেবাখাত প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে সেসব ড্রোনবিরোধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিয়েভকে দিতে যাচ্ছে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র এ বছরের মাঝামাঝি ইউক্রেনকে ৪টি ও বছর শেষে আরও ১০টি ভ্যাম্পায়ার ইউনিট দেবে, যা শক্রপক্ষের ড্রোন ধ্বংস করতে সাহায্য করবে।

ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলোর এসব সামরিক সহায়তার সংবাদ ক্রেমলিনের জন্য মোটেও সুখবর নয়। এমনকি, যুদ্ধ চলাকালে পশ্চিমের মিত্র দেশগুলো থেকে কিয়েভ যে সহায়তা পেয়েছে তা রুশ বাহিনীর সব অগ্রযাত্রা বানচালে ভূমিকা রাখে।

এসব বিবেচনায় নিয়ে দেখা যায়, গত কয়েক শ বছরের যুদ্ধের ইতিহাসে রাশিয়ার শীত বা 'জেনারেল উইন্টার' যে ভূমিকা রেখেছিল বা যে শীত দিয়ে ইউক্রেনের রুশবিরোধী সরকারের পতনকে তরান্বিত করার আশা করেছিল ক্রেমলিন তা এবারের শীতে এখনো পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। বরং, 'জেনারেল উইন্টার' যেন প্রেসিডেন্ট পুতিনকে এই বার্তাই দিলেন যে, 'প্রযুক্তির কাছে প্রকৃতিনির্ভর যুদ্ধকৌশল অচল আধুলির মতোই'।

Comments

The Daily Star  | English
US attack on Iran nuclear sites

Iran denounces US attack as ‘outrageous’

Iran says 'no signs of contamination' after US attacks on key nuclear sites

7h ago