মিঠা পানির পাবদা লবণাক্ত পানিতে

পাবদা মাছ
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার হাসানপুর গ্রামে লবণাক্ত পানিতে মিঠা পানির পাবদা চাষ করছেন এক সময়ের চিংড়ি চাষি আলাউদ্দিন জোয়াদ্দার। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

মিঠা পানির মাছ হিসেবেই পরিচিত পাবদা মাছ। অথচ, লবণাক্ত এলাকায় পাবদা চাষ করছেন ডুমুরিয়ার আলাউদ্দিন জোয়াদ্দার। শুধু চাষ নয়, লবণাক্ত এলাকায় পাবদা চাষ করে দারুণ সফলতা পেয়েছেন তিনি। প্রতিবছর ৫০-৬০ লাখ টাকার পাবদা মাছ বিক্রি করছেন। তার চাষ করা পাবদা মাছ বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতেও রপ্তানি হচ্ছে।

একসময় গলদা চিংড়ি চাষ করতেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার হাসানপুর গ্রামের আলাউদ্দিন জোয়ারদার (৩৭)। কিন্তু, কয়েক বছর চিংড়ি চাষ করেও সফলতার দেখা পাচ্ছিলেন না। তাই বেছে নেন পাবদা চাষকে।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের এখানে মানসম্মত চিংড়ি পোনা পাওয়া যায় না। হ্যাচারি থেকে যে পোনা পাওয়া যায় তা খুব মানসম্মত নয়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে যে পোনা পাওয়া যায় তা সংগ্রহ করাও সহজ ছিল না। কারণ নদী থেকে চিংড়ির রেণু সংগ্রহ করতে হয়। যা সবসময় সহজ ছিল না।'

তিনি আরও বলেন, 'পারিবারিকভাবে আমাদের কিছু আবাদি জমি আছে। তবে, আমি লেখাপড়া না জানায় কৃষি ছাড়া অন্য কোনো পেশায় যুক্ত হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তাই কৃষির পাশাপাশি চিংড়ি চাষ করতে শুরু করি। কিন্তু, চিংড়ি চাষে লাভ হচ্ছিল না।'

পাবদা মাছ
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার হাসানপুর গ্রামে লবণাক্ত পানিতে মিঠা পানির পাবদা চাষ। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

'একসময় আমাদের অঞ্চলে ময়মনসিংহ থেকে কয়েকজন বেড়াতে আসেন। তারা আমাকে মাছ চাষের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেন। তারা বলেছিলেন, ময়মনসিংহের সমতলভূমির যে স্থানীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় তা চাষ করে লাভবান হওয়া সম্ভব। আমি তাদের কথা মতো ময়মনসিংহে যাই। সেখান থেকে ৭০ হাজার শিং মাছ , ১ লাখ ৩ হাজার গুলসা টেংরা পোনা ও  ১ লাখ পাবদা পোনা কিনে আনি। পাবদা কিনতে ব্যয় হয়েছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা,' বলেন তিনি।

আলাউদ্দিন জোয়াদ্দার বলেন, 'কিন্তু যথাযথ ধারণা না থাকায় লোকসানে পড়ে যাই। পাবদা চাষে সবচেয়ে বড় সমস্যা একই সাইজের মাছ না দিলে বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। যেহেতু আমি একই পুকুরে শিং মাছ এবং পাবদা দিয়েছিলাম, তাই বড় পাবদা শিং মাছ ছোট পাবদা খেয়ে ফেলল। তখন ৫ হাজারের মতো পাবদা বেঁচে ছিল, যা পরবর্তীতে প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করি। সব মিলে সে বছর ৩-৪ লাখ টাকা লোকসান হয়।'

তবে, লোকসান হলেও হাল ছাড়েননি আলাউদ্দিন জোয়াদ্দার। তিনি বলেন, 'আমি তবুও হাল ছাড়িনি। পরিবারের নিষেধ সত্ত্বেও আবার ১ লাখ পাবদার পোনা এনে চাষ করি। সেবার প্রায় ৮৫ শতাংশ পাবদার পোনা টিকে ছিল। প্রতি কেজি পাবদা ৬৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। সে বছর আগের সব লোকসান কাটিয়ে প্রায় ৩ লাখ টাকা লাভ করি।'

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার হাসানপুর গ্রামে লবণাক্ত পানিতে মিঠা পানির পাবদা চাষে সফল আলাউদ্দিন জোয়াদ্দার। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

এরপর আর থেমে থাকেননি আলাউদ্দিন জোয়াদ্দার। শুরু করেন আরও বড় পরিসরে পাবদার চাষ। তিনি বলেন, '২০১৮ সালে স্থানীয় মৎস্য অফিসারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার পরামর্শে বড় করে পাবদা চাষ শুরু করি। প্রতিবছর ৫ লাখ টাকার চুক্তিতে ৫ বছরের জন্য ১০ বিঘা জমি লিজ নেই। সে বছর বগুড়া থেকে ৫ লাখ পাবদার পোনা কিনে এনে চাষ শুরু করি। সঙ্গে ছিল ১০ হাজার রুই ও কাতলা।'

'২০২১ সালে ওই পুকুরে আমার মোট খরচ হয় ২৭ লাখ টাকা। কিন্তু, আমি এক দিনেই বিক্রি করি ১৭ লাখ টাকার মাছ। সব মিলিয়ে ৫০ লাখ টাকার মতো আয় করি। আমার থেকে পাবদা কিনে এলসির মাধ্যমে ভারতে বিক্রি করছেন স্থানীয় ২ জন মৎস্য ব্যবসায়ী। গত বছর আমার পুকুরের ২২৫ মণ মাছ কলকাতায় রপ্তানি হয়েছিল। এ বছর এখন পর্যন্ত ৮০ মণ মাছ রপ্তানি হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে আরও ১৫০ মণ মাছ রপ্তানি হওয়ার কথা।'

আলাউদ্দিন জোয়াদ্দারের কাছ থেকে মাছ কিনে ভারতে রপ্তানি করেন টিটো মোল্লা। এই মাছ ব্যবসায়ী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি বগুড়া ও ময়মনসিংহ থেকে পাবদার রেণু পোনা এনে চাষিদের কাছে বিক্রির পাশাপাশি মাছের খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করি। ৪-৫ মাস পর সেই খামার থেকে মাছ কিনে কলকাতায় পাঠাই। সেখানে পাবদার ভালো চাহিদা আছে।'

আলাউদ্দিন জোয়াদ্দার জানান, নিয়ম মেনে তার পুকুরে খাবার ও ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি পানিতে অক্সিজেনের সরবরাহ ঠিক রাখতে সার্বক্ষণিক ৫টি অ্যারেটর চালানো হয়। এ বছর তিনি ৩ ধাপে মাছ বিক্রি করে ৬২ লাখ টাকা লাভ করেছেন। আরও ৫০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা আছেন। এখন প্রতি মণ ১৩ হাজার টাকা দরে পাবদা বিক্রি হচ্ছে। সাধারণত ২৫-৩০টা মাছে ১ কেজি হয়।

'সাম্প্রতিক সময়ে খাবারের মূল্য অনেক বেড়েছে। ২৫ কেজির একটি প্যাকেট ২ হাজার ৩৮ টাকায় কিনতে হয়। প্রতিদিন আমার ১৪-১৫ হাজার টাকা খাবার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় হয়,' বলেন আলাউদ্দিন জোয়াদ্দার।

তিনি বলেন, 'পাবদা মাছ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলে। একটি পুকুরে বছরে ৩ বার পাবদা চাষ করা যায়। কিন্তু, সমস্যা অন্য জায়গায়। উত্তরবঙ্গের মতো আমাদের এখানকার পুকুর সমতল ভূমির না। গভীর পুকুর না হলে পাবদা মাছ চাষ করা কঠিন। সবসময় অন্তত ৩-৪ হাত পানি থাকা লাগবে।'

মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপপরিচালক তোফাজ উদ্দিন আহমেদসহ একটি প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে আলাউদ্দিনের পুকুর পরিদর্শন করেছেন বলে জানা গেছে।

ডুমুরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খুলনার মতো লবণাক্ত অঞ্চলে ৬০ প্রজাতির স্থানীয় মাছ চাষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। আলাউদ্দিনের মতো অনেকেই এখন স্থানীয় প্রজাতির মাছ চাষ করছে। গলদা-বাগদা-রুই জাতীয় মাছের এলাকা বলে খ্যাত ডুমুরিয়াতে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির পাবদা মাছ চাষে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, বেকার সমস্যার সমাধান, আর্থিক সমৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আমরা পাবদা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

4h ago