জানা-অজানা

যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বদলে দিয়েছে ৭০ দশকের জ্বালানি সংকট

জ্বালানি সংকটের সময় যুক্তরাষ্ট্রের একটি পাম্প স্টেশন। ছবি: হিস্ট্রি.কম

১৯৬৭ সালের ঐতিহাসিক ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পার্শ্ববর্তী সিরিয়া, জর্ডান ও মিসরের নিয়ন্ত্রণাধীন বিশাল ভূখণ্ড দখল করে নেয়। এসব দখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে আরব দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বড় প্রভাবশালী দুটি দেশ মিশর ও সিরিয়া একযোগে ইসরায়েলে আক্রমণ করে। ৬ অক্টোবর এ যুদ্ধ শুরু হয়ে ২৫ অক্টোবর শেষ হয়।

ইতিহাসে এটি 'ইওম কিপুর' কিংবা 'আরব-ইসরায়েল চতুর্থ যুদ্ধ' নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিশর ও সিরিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশ দুটিকে ব্যাপক যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ করে। আর ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে ব্যাপক আধুনিক ও বিধ্বংসী অস্ত্র সরবরাহ করে।

ইসরায়েলকে সমর্থনের প্রতিবাদে তেল উত্তোলনকারী দেশগুলোর জোট অর্গানাইজেশন অব আরব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিস (ওপেক) নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তেল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এ নিষেধাজ্ঞার ফলাফল ছিল ভয়াবহ। তেলের দাম নিমিষেই ৪ গুণ হয়ে যায়।

গ্যাস স্টেশনগুলোতে গাড়ির দীর্ঘ সারি তখন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। মার্কিন সরকার তখনকার পরিস্থিতি সামাল দিতে এমন কিছু সিদ্ধান্ত, আইন ও নীতি প্রণয়ন করে, যার প্রভাব ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এবং যুক্তরাষ্ট্র এখনো সেই সময়ে নেওয়া সিদ্ধান্তের সুফল ভোগ করছে।

বিপদে পড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকার যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেগুলো বেশ কিছু উদ্ভাবনকেও ত্বরান্বিত করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জানালার কাঁচে এক বিশেষ প্রলেপ এবং ভবনের নকশায় পরিবর্তন।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় গঠন

পরিবর্তিত জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ১৯৭৭ সালে এক ভাষণে বেশ কিছু প্রস্তাব ঘোষণা করেন। তার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জ্বালানি মন্ত্রণালয় গঠন। দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট কার্টার বলেন, 'জ্বালানি সংকট এখনো পুরোপুরি আমাদেরকে কাবু করতে পারেনি। তবে আমরা যদি খুব দ্রুত কোনো ব্যবস্থা না নেই, তাহলে সেটিই ঘটবে। ... উৎপাদক ও ভোক্তা, উভয়েরই জন্যই ভরসাযোগ্য নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করতে পারেন। এ জন্য আমি কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করে জ্বালানি মন্ত্রণালয় গঠন করতে চাইছি। বর্তমানে যে ৫০টিরও বেশি সংস্থা মার্কিন জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে, তাদের পরিবর্তে জ্বালানি মন্ত্রণালয় এককভাবে পুরো কাজ করবে।'

বছরের আরও পরের দিকে প্রেসিডেন্ট কার্টার 'ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি অর্গানাইজেশন অ্যাক্ট অব ১৯৭৭' এ সই করেন, যার ফলে দেশটিতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের জন্ম হয়। এই মন্ত্রণালয় মার্কিন সব জাতীয় জ্বালানি কার্যক্রমকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসে এবং দেশের জন্য সমন্বিত জ্বালানি কর্মপদ্ধতি তৈরি করে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে এই মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মার্কিন 'নিউক্লিয়ার এনার্জি'র অফিসও এখন এই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন।

আধুনিক প্রযুক্তির জ্বালানি সাশ্রয়ী জানালা উদ্ভাবন

৭০ দশকে জ্বালানি মন্ত্রণালয় কম নির্গমন জানালার প্রলেপ আবিষ্কারের জন্য গবেষণায় বরাদ্দ দেয়। যার ফলে আবিষ্কৃত হয় 'লো-ই' (low-E) প্রলেপ। এই অভাবনীয় আবিষ্কার ছিল তৎকালীন জ্বালানি সংকটের সরাসরি ফলাফল।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দ্য লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাব জানালার কাঁচ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে জ্বালানি সাশ্রয়ী কাঁচ বাজারজাত করে। কাঁচের ওপর নতুন এই প্রলেপ গ্রীষ্মকালে ঘরকে বাইরের তুলনায় ঠাণ্ডা রাখে, আর শীতকালে বাইরের তুলনায় গরম রাখে।

মার্কিন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, বাণিজ্যিক বাজারে বিক্রি হওয়া অর্ধেকের বেশি এবং রেসিডেন্সিয়াল বাজারে বিক্রি হওয়া ৮০ শতাংশেরও বেশি কাঁচে এই লো-ই প্রলেপ সংযুক্ত থাকে, যার ফলে অন্তত ৪০ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় হয়।

পদার্থবিদ স্টিভ সেলকোয়িৎজ এটি আবিষ্কার করেন। তিনি বলেন, 'এই ধারণা, কিছু উপকরণ ও পেটেন্ট তখনো ছিল। কিন্তু বাকি ছিল তত্ত্বীয় ব্যাপারটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া এবং একে টেকসই পণ্যে পরিণত করে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে পৌঁছে দিয়ে বিশালাকার জ্বালানি সাশ্রয় করা।'

ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের তথ্য অনুসারে, লো-ই প্রলেপযুক্ত জানালা ভোক্তাদের শত কোটি ডলার সাশ্রয় করেছে। এই প্রযুক্তি পরবর্তীতে আরও উন্নত হতে হতে বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বর্তমানে অনেক জ্বালানি সাশ্রয়ী বাতি আবিষ্কৃত হয়েছে এই প্রযুক্তির অগ্রসরতার ফলেই।

১৯৭৯ সালের ২০ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার হোয়াইট হাউসে স্থাপন করা সোলার হট ওয়াটার হিটিং সিস্টেম পরিদর্শন করছেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সাংবাদিকরা। ছবি: এপি

হোয়াইট হাউজের ছাদে সোলার প্যানেল

জ্বালানি সংকট শুরু হওয়ার পর এর প্রভাব পরবর্তী কয়েকজন প্রেসিডেন্টকেই মোকাবিলা করতে হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ৮ অক্টোবর দায়িত্ব নেওয়ার ঠিক ২ মাস পর প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড কংগ্রেসে দেওয়া ভাষণে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর ঘোষণা দেন। ভাষণে তিনি জ্বালানি সাশ্রয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড তার ভাষণে বলেন, 'জ্বালানি সংকটের মধ্যে জ্বালানির দুষ্প্রাপ্যতা রোধে কম গাড়ি চালান, বাসা কম গরম করুন।'

১৯৭৭ সালে কোর্ডিগান সোয়েটার গাড়ে দিয়ে আগুন পোহাতে পোহাতে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার মার্কিন জনগণকে আহ্বান করেছিলেন, তারা যাতে শীতকালে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট এড়াতে দিনের বেলায় বাসার তাপমাত্রা ৬৫ ডিগ্রি এবং রাতের বেলায় ৫৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটে রাখেন।

ওই বছরের এপ্রিলে দেওয়া ভাষণে কার্টার সবাইকে সতর্ক করে বলেন, মানুষ যদি জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে কোনো ত্যাগ স্বীকার না করে, তাহলে এটি 'জাতীয় দুর্যোগে' পরিণত হবে। তিনি বলেন, 'যুদ্ধ এড়ানোর বাইরে আমাদের জীবদ্দশায় আমাদের দেশের জন্য এটাই হবে সবচেয়ে বড় সংকট।'

১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট কার্টার হোয়াইট হাউজের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করেছিলেন। মানুষকে আরও বেশি জ্বালানি সাশ্রয়ী করতে এটি ছিল একটি প্রতীকী সিদ্ধান্ত। অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, পুনঃব্যবহারযোগ্য ও ক্লিন এনার্জির ক্ষেত্রে কার্টার ছিলেন তার সময়ের তুলনায় অগ্রগামী।

কার্টার বলেছিলেন, 'এখন থেকে এক প্রজন্ম পর এই সোলার প্যানেলগুলো হয় জাদুঘরে থাকবে, একটি বাতিল সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচ্য হবে, নতুবা এটি হবে আমেরিকার জনগণ কর্তৃক গৃহীত এমন এক ঐতিহাসিক ও রোমাঞ্চকর যাত্রা, যা বিদেশি তেলের ওপর ধ্বংসাত্মক নির্ভরতা বাদ দিয়ে সূর্যের শক্তিকে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কাজে লাগাবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

3h ago