কলাপাড়ায় বছরে ৩ কোটি টাকার গোলের গুড়, মিলছে না ন্যায্যমূল্য

জ্বাল দিয়ে গুড় প্রস্ততের কাজ চলছে। ছবি: সোহরাব হোসেন/ স্টার

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় গোল গাছ থেকে সংগৃহীত রস থেকে বছরে প্রায় ৩ কোটি টাকার গোলের গুড় তৈরি হয়। কিন্তু গুড় প্রস্তুতকারকরা বলছেন, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ, মিঠাকঞ্চ, পাখি মারা ইত্যাদি গ্রামে কয়েক বছর ধরেই গোলের গুড় তৈরি চলছে। পতিত জমিতে বেড়ে ওঠা গোল গাছ থেকে শীতকালীন গোলের রস সংগ্রহ করা হয়। পরে তা আগুনে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করে বাজারজাত করা হয়।

দীপন নামের এক গুড় প্রস্তুতকারক জানান, অগ্রহায়ণ মাস এলেই গোল গাছের ফল নিয়ে যে কাণ্ড বের হয় সেটির মাথা ধারালো দা দিয়ে কাটা হয়। সেই অংশ থেকেই ফোঁটায় ফোঁটায় রস বের হয়। ওই রস সংগ্রহ করা হয় আগার সঙ্গে প্লাস্টিকের বা মাটির পাত্র রশি দিয়ে ঝুলিয়ে।

প্রতিদিন খুব সকালে ও বিকেলে এ রস সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে এসে বড় উনুনে টিনের পাত্রে আগুনে জ্বাল দেওয়া হয়। ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা জ্বাল দিলে এই রস গুড়ে পরিণত হয়। পরে তা প্লাস্টিকের কৌটায় ভরে বাজারজাত করা হয়। গোলের রস থেকে গুড় তৈরিতে কোনো ধরনের ঔষধ ব্যবহার করা হয় না বলে এটি স্বাস্থ্যসম্মত এবং খেতে খুবই সুস্বাদু।

কলাপাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের কর্মকর্তা এ আর এম সাইফুল্লাহ জানান, এ উপজেলায় ৫৫ হেক্টর জমিতে গোলগাছ রয়েছে। অগ্রহায়ণ মাস থেকে চৈত্র পর্যন্ত গোল গাছ থেকে স্থানীয়রা রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করছেন।

তিনি আরও জানান, উপজেলার নীলগঞ্জ, নবীপুর, নিয়ামতপুর, পাখিমারা মিঠাগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকার ৩০০ পরিবার এগুলো উৎপাদনে জড়িত। এখানে বছরে ৩ কোটি টাকার গুড় তৈরি হয় এবং দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন এসব গুড় কেনেন। এখানকার গোলের গুড় খুবই সুস্বাদু এবং চাহিদা সম্পন্ন। স্থানীয়রা এ গোলের গুড় তৈরি করে মৌসুমভিত্তিক বাড়তি উপার্জনের সুযোগ পান।

গোলের রস সংগ্রহ করা হচ্ছে। ছবি: সোহরাব হোসেন/ স্টার

গোলের গুড় প্রস্তুতকারক নবীপুর এলাকার বাসিন্দা হরি নারায়ণ মিত্র জানান, বাপ দাদার মতো তিনিও গোলের রস থেকে গুড় উৎপাদন করছেন। তাদের উৎপাদিত গুড় স্থানীয় খুচরা বাজারে বিক্রি করতে হয়। কিন্তু সরকারিভাবে এখানে একটি বাজারের ব্যবস্থা করা হলে তারা ভাল দাম পেতেন এবং গুড় উৎপাদনকারীরা লাভবান হতে পারতেন।

গুড় প্রস্তুতকারক পরিমল হাওলাদার জানান, তিনি ৩০০ গোল গাছ থেকে প্রতিদিন ৮-১০ কলস রস সংগ্রহ করতে পারেন এবং সেখান থেকে দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ কেজি গুড় তৈরি পারেন।

প্রতি কেজি ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন।

পরিমলের স্ত্রী সুনিতি হাওলাদার জানান, ঢাকা, পাবনা, বরিশাল, খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গুড় কিনে নেন ক্রেতারা। পাবনার একটি কোম্পানিকে ইতোমধ্যে ১০০ কেজি গুড় কুরিয়ারের মাধ্যমে সরবরাহ করেছেন বলেও জানান তিনি।

একই এলাকার উত্তম হাওলাদার জানান, তিনি ৩৫০টি গোল গাছ থেকে গড়ে দৈনিক ১০ কলস সংগ্রহ করেন। এতে তার ৩০ কেজি গুড় উৎপন্ন হয়।

কলাপাড়া উপজেলা শহরের সাপ্তাহিক বাজারে নিয়ে তিনি এসব গুড় বিক্রি করেন। কিছু কিছু ক্রেতারা বাড়ি থেকেও গুড় কিনে নেন বলেও জানান তিনি।

'সরকারিভাবে একটি বাজার তৈরি করা হলে সেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা গুড় কিনলে আমরা আরো ভালো দামে গুড় বিক্রি করতে পারতাম এবং আরো লাভবান হতে পারতাম', বলেন তিনি।

একই এলাকার গুড় প্রস্তুতকারক শুভ হাওলাদার জানান, গোল গাছগুলো এমনিতেই নিচু জমিতে জন্মে থাকে। এ গাছের কোনো পরিচর্যা করতে হয় না। তাই গাছ বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোনো খরচ নেই। তবে রস সংগ্রহের জন্য প্লাস্টিকের পাত্র ও মাটির পাত্রের দাম গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়েছে।

গ্রামের বাসিন্দা শশধর হাওলাদার জানান, 'গোল গাছ থেকে শুধু রসই পাওয়া যায় না, গোল গাছের পাতা থেকে ঘরের ছাউনি ও জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। তবে এই এলাকায় গোলের বাগান ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কারণ অনেকেই গোল গাছ ধ্বংস করে তা কৃষি জমিতে পরিণত করে ধান আবাদ করছেন।'

কলাপাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের কর্মকর্তা এ আর এম সাইফুল্লাহ জানান, 'গোলের গুড় যেন সঠিকভাবে বাজারজাত করা হয় এবং প্রস্তুতকারকরা সঠিক মূল্য পান সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

41m ago