ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষণে আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি

আদানি গ্রুপের গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র। ছবি: গুগল আর্থ থেকে নেওয়া

ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনছে বাংলাদেশ। আদানি গ্রুপের এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বাংলাদেশের সঙ্গে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ বিষয়ক ১৬৩ পৃষ্ঠার 'গোপন চুক্তি' নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট

গত ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনটি মূলত আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। এর একটি বড় অংশজুড়ে আছে আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক ব্যবসা, যার একটি গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্প। ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অবস্থিত এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রপ্তানি হবে বাংলাদেশে।

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের জুনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে ভারতের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করেন।

নরেন্দ্র মোদির এই সফরের পর ভারতের বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ গৌতম আদানির সঙ্গে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে গোড্ডায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করে।

ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে বলছে, এই বিদ্যুৎ বিষয়ক চুক্তিটি প্রথমে বাংলাদেশ ও ভারতের 'উভয়ের জন্য লাভজনক' বলে মনে হলেও আসলে তা বাংলাদেশের জন্য 'খুবই কম লাভজনক'।

প্রতিবেদন বলছে, এটি ছিল নরেন্দ্র মোদির জন্য 'প্রতিবেশী প্রথম' নীতিকে শক্তিশালী করার ও ভারতীয় ব্যবসার প্রচারের একটি সুযোগ।

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রবেশের সুবিধা' দিতে বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে হওয়া ১৬৩ পৃষ্ঠার 'গোপন চুক্তিপত্রে'র কপি পেয়ে তা ৩ জন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে পর্যালোচনা করানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট

চুক্তি পর্যালোচনা করে ওয়াশিংটন পোস্টকে সিডনিভিত্তিক জ্বালানি বিশ্লেষক টিম বাকলি জানিয়েছেন, গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার পর কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বছরে প্রায় সাড়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে বাংলাদেশকে। বিদ্যুৎখাতের বৈশ্বিক মান অনুসারে যা 'উচ্চমূল্য'।

এতে আরও বলা হয়েছে, সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় বাংলাদেশ কবে বিদ্যুৎ পাবে, তা স্পষ্ট নয়।

গত ৯ ডিসেম্বর ওয়াশিংটন পোস্টে প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়।

তবে, গত ২০ নভেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা থেকে জানা গেছে, আগামী ১৬ ডিসেম্বর ভারতের ঝাড়খণ্ডের আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসা শুরু হবে। ওই দিনটিতে ২ ইউনিটের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটির কমার্শিয়াল অপারেশনস ডেট (সিওডি) নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া, দ্বিতীয় ইউনিটের কমার্শিয়াল অপারেশনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী বছরের ২৬ মার্চ।

যদিও ১৬ ডিসেম্বর এ বিদ্যুৎ আসছে না বলে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন।

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, কয়লা ও গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে এখন সর্বোচ্চ চাহিদার তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে উল্লেখ করে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন বলছে, ভারতের এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশে প্রয়োজন নাও হতে পারে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম যত বেশিই হোক না কেন, বাংলাদেশ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পরিশোধ করে। অথচ, আদানির সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী দেবে। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে কয়লার দাম প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে।

আদানির নিজস্ব কয়লার ব্যবসা থাকায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করতে পারে তার প্রতিষ্ঠানই। প্রকল্পের পরিবেশগত ছাড়পত্রের নথির বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে ৭ মিলিয়ন টন কয়লা এখানে অন্য দেশ থেকে সরবরাহ করা হবে।

চুক্তি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, এই কয়লা আসতে পারে আদানির মালিকানাধীন ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি বন্দরে। এরপর সেখান থেকে তা আদানির নির্মিত রেলে পৌঁছাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ আদানি হাই-ভোল্টেজ লাইনের মাধ্যমে আসবে বাংলাদেশ সীমান্তে। আর এই সবের পরিবহনের খরচ বহন করবে বাংলাদেশ।

দক্ষিণ এশিয়ায় জ্বালানি নিয়ে কাজ করা বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন টিম বাকলি। তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, এই চুক্তি অনুযায়ী দেশের পাইকারি বিদ্যুতের বাজার মূল্যের ৫ গুণেরও বেশি দামে আদানির বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। এমনকি কয়লার দাম ইউক্রেন যুদ্ধের আগের পর্যায়ে ফিরে গেলেও অভ্যন্তরীণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে খরচ সরকার দেখায়, তারচেয়ে অন্তত ৩৩ শতাংশ বেশি দামে এই বিদ্যুৎ কিনতে হবে। বাংলাদেশের কাপ্তাই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় আদানির বিদ্যুতের দাম পড়বে ৫ গুণ বেশি।

'আদানির সঙ্গে করা এই চুক্তিটি অবশ্যই প্রতারণা', বলেন টিম বাকলি।

বাংলাদেশি পরিবেশকর্মী হাসান মেহেদী ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র সাধারণত অলস পড়ে থাকে। গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশের জ্বালানি ভবিষ্যৎকে কয়লায় আটকে রাখবে।

তিনি বলেছেন, 'এই বিদ্যুৎকেন্দ্র কম খরচের সোলারের সুযোগ কমিয়ে দেবে। অন্যদিকে, কয়লার কারণে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুতের জন্য আরও বেশি টাকা খরচ করতে হবে।'

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুতের উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাংলাদেশ পরিকল্পিত ১৮টি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্যে ১০টি বাতিল করেছে ২০২১ সালে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন সাংবাদিকদের বলেছেন, কয়লা নিয়ে 'বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ' থাকায় ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু, এরপরেও আদানির প্রকল্প চলছে।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতুল্লাহ আদানির সঙ্গে হওয়া চুক্তি পর্যালোচনা করে ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, 'চুক্তিটি বাংলাদেশের পক্ষে না থাকলেও শেখ হাসিনা ভারতকে রাগাতে পারবেন না। কোনটা খারাপ এবং কোনটা ভালো, তা তিনি জানেন। তিনি এও জানেন যে, আদানিকে খুশি করলে মোদিও খুশি হবেন।'

এসব অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে ওয়াশিংটন পোস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন মুখপাত্র ও বাংলাদেশি জ্বালানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করলেও তারা কোনো জবাব দেননি।

২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী গত বছরের ডিসেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার কথা। ১ বছরের বেশি সময় পর চালু হতে যাওয়া প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৯৩ দশমিক ৫২ শতাংশ।

ভারতের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত ১০৫ দশমিক ৯ কিলোমিটার ও বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে জাতীয় গ্রিড পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের কমিশনিং সম্পন্ন হয়েছে। গত ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ গ্রিড থেকে ব্যাকফিড পাওয়ার প্রদান করা হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

9h ago