১৫ নভেম্বর থেকেই শুরু হয়েছিল পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আজহারুল হক। ছবি: সংগৃহীত

সেদিন ছিল সোমবার। আগের ২ দিন সাপ্তাহিক ছুটির কারণে আমার স্বামী হাসপাতালে যাননি। তাই সেদিন তাড়াতাড়িই বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। কারফিউ থাকায় এবং অ্যাপ্রন ফেলে আসায় হাসপাতালে ফোন করে তিনি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বললেন। এরপর বাসা থেকে যখন নিচে নামলেন তখনই গেটের কাছেই আলবদর সদস্যরা তাকে ঘেরাও করে ফেললো।'

'আজহারের সঙ্গে মেডিকেলের ইন্টার্ন ডা. হুমায়ূন কবীরও ছিলেন। তাদের সঙ্গে কী কথা হয়েছে দূরত্বের কারণে কেউ শুনেনি। কিন্তু, আজহারের হাতে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে দেখেছিল। উনি তখন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর তাকে কিছুটা হাঁটিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হয়।'

'পরদিন সকালে আমরা তার মরদেহে গুলির চিহ্ন পেলাম না। গলার কাছে লম্বা দাগ আর, শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম অনবরত বুট দিয়ে লাথি মেরে নির্যাতন করে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়।'

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড
শহীদজায়া সালমা হক। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে স্বামীকে হারানোর দিনটির বর্ণনা দিতে গিয়ে গলা ধরে আসে সত্তরোর্ধ্ব শহীদজায়া সৈয়দা সালমা হকের। তার চোখে ভর করে অশ্রু। স্বামী শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আজহারুল হককে যখন হারিয়েছিলেন তখন তিনি ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বললেন, 'প্রথম সন্তানের মুখটিও দেখে যেতে পারলেন না তিনি।'

মুক্তিযুদ্ধের ১৫ নভেম্বর সকালে ধানমণ্ডির হাতিরপুলের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাসার সামনে থেকে আলবদরেরা তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী শল্যচিকিৎসক ডা. আজহারুল হক ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ডা. হুমায়ুন কবীরকে। পরদিন ১৬ নভেম্বর সকালে তাদের মরদেহ পাওয়া যায় নটরডেম কলেজের দক্ষিণপূর্ব কোণায় কালভার্টের নিচে। উদ্ধারের সময় তাদের হাত, পা ও চোখ বাঁধা ছিল। শরীরে ছিল আঘাতের চিহ্ন।

এই ২ চিকিৎসকের শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়েই মূলত সূচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে সুপরিকল্পিত কায়দায় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার বাস্তবায়ন। মুক্তিযুদ্ধের ১৫ নভেম্বরে শুরু হওয়া সুপরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড একাধারে চলেছে ১৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার একমাত্র কারণ ছিল দেশকে পুরোপুরি জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তার প্রসারতা শূন্য করা। বুদ্ধিজীবীরা তাদের জ্ঞান, মেধা, চিন্তার প্রসারতা ও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান।

পাকিস্তানি বাহিনীর জানা ছিল যদি কোনো দেশ বা জাতিকে অন্তঃসারশূন্য করতে হয় তবে বুদ্ধিজীবীশূন্য করাটাই যথেষ্ট হবে। এ জন্যই পরিকল্পিত কায়দায় ঠান্ডা মাথায় চালানো হয় এই চরম পৈশাচিক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আজহারুল হক ও ডা. হুমায়ূন কবিরকে পাওয়া গিয়েছিল নটরডেম কলেজের পাশের এই স্থানে। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধে সুপরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সূচনা হয়েছিল আগস্টে। সে মাসে সাংবাদিক পরিচয়ে ঢাকায় এসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারের ২ বিশেষ দূত ডুসপিক ও হেইট।

ডুসপিক ছিলেন মূলত সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) ও হেইট ছিলেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা।

সেসময় তারা ঢাকায় গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে ঢাকা থেকে ব্যাংকক হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেন। হেনরি কিসিঞ্জার মূলত বৃহৎ পরিসরে বাংলাদেশে গণহত্যা হোক তা চাননি। এজন্যই পরিকল্পনা হয়েছিল যদি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা যায় তাহলে সামগ্রিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ স্তিমিত হয়ে যাবে। দেশ ঘুরে দাঁড়াতে চরমভাবে ব্যর্থ হবে।

ডুসপিক ও হেইট যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার পর বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার জন্য রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে গভর্নর হাউসে ও ব্রিগেডিয়ার বশির আহমেদের নেতৃত্বে ঢাকা সেনানিবাসে একাধিক বৈঠক।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর সর্বপ্রথম আলবদরের চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান খানের ৩৫০/ নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় ডায়েরি। সেই ডায়েরিতে পাওয়া গিয়েছিল ২০ বুদ্ধিজীবীর নাম। তারা সবাই পরবর্তীতে নিখোঁজ হয়েছিলেন।

তাদের মধ্যে ৮ বুদ্ধিজীবীকে আশরাফুজ্জামান খান নিজে গুলি করে হত্যা করেছিলেন বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাক্ষ্যে উল্লেখ্য করেন সাক্ষী মফিজুদ্দিন।

বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, রশিদুল হাসান, ড. ফয়জুল মহী ও চিকিৎসক ডা. গোলাম মুর্তজা।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রধান কুশীলব মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের পরে গভর্নর হাউসের একটি ডেস্কে পাওয়া গিয়েছিল রাও ফরমান আলীর স্বহস্তে লেখা ডায়েরি। এতে ছিল প্রায় ৩ হাজার বুদ্ধিজীবীর তালিকা। এর মধ্যে অনেক বুদ্ধিজীবীর নামের পাশে ছিল ক্রস চিহ্ন। কোনো কোনো নামের পাশে লেখা ছিল বাড়ির নম্বর। ছিল মন্তব্যও।

যাদের নামের পাশে ক্রস চিহ্ন ছিল তাদের মধ্যে সব বুদ্ধিজীবীই নিখোঁজ হয়েছিলেন। নোটশিটের এক জায়গায় লেখা ছিল বুদ্ধিজীবীদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা। লেখা ছিল আলবদরদের যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করবেন ক্যাপ্টেন তাহির। রাও ফরমান আলীকে এই বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা করতে সহযোগিতা করেছিলেন আলবদরের শীর্ষ নেতারা।

১৫ নভেম্বর ডা. আজহারুল হক ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হুমায়ুন কবীরকে হত্যার পর শহীদ হয়েছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন। ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ৩টার দিকে শান্তিনগরের চামেলীবাগের ভাড়া বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী।

১১ ডিসেম্বর ভোর ৪টার দিকে পিপিআইর প্রধান প্রতিবেদক ও কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হককে পুরানা পল্টনের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। যারা তুলে নিয়েছিল তারাই ভোর ৬টার দিকে গোপীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক এএনএম গোলাম মুস্তাফাকে।

১২ ডিসেম্বর আলবদরের বেশ কয়েকজন তরুণ পিপিআইর জেনারেল ম্যানেজার ও বিবিসির প্রতিবেদক নিজামউদ্দিন আহমেদকে পুরান ঢাকার কলতাবাজারের বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

১৩ ডিসেম্বর সকাল ৮টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও মহসিন হলের হাউস টিউটর ড. গিয়াসউদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যায় তারা।

একই দিন দুপুরের দিকে সিদ্ধেশ্বরীর ১১৫ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে দৈনিক শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীরকে সচিবালয়ে নেওয়ার কথা বলে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড
আলবদরের অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মইনুদ্দীন। ছবি: সংগৃহীত

১৪ ডিসেম্বর গণহারে একে একে বুদ্ধিজীবীদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে আলবদর সদস্যদের সহযোগিতায় তুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। এর সূচনা হয় দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে।

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে উঠিয়ে নেওয়ার সময় মুখের কাপড় সরে গেলে প্রকাশ পায় আলবদরের অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের চেহারা। তাকে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর চিনে ফেলার অন্যতম কারণ তিনি বাংলা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলেন।

এর একটু পরে সেন্ট্রাল রোডের বাসা থেকে নাট্যকার মুনীর চৌধুরী ও সেদিন সন্ধ্যায় কায়েতটুলির বাসা থেকে শহীদুল্লা কায়সারকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেদিন অগণিত বুদ্ধিজীবীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আলবদর বাহিনী। ১৪ ডিসেম্বর ঠিক কতজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এর সঠিক তালিকা পাওয়া যায় না।

১৫ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফজলে রাব্বিকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর সদস্যরা।

এদিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে একই কায়দায় প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীকে তার বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় আলবদরের সদস্যরা।

১৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আলবদর সদস্যরা আজিমপুরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদকে। আবুল কালাম আজাদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ গুণীজন।

দেশ স্বাধীনের পর পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কয়েকজনের অর্ধ গলিত মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। কারো কারো মরদেহ ততদিনে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় শনাক্ত করা হয়েছিল পরনের কাপড় ও জুতা দেখে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষ্যগ্রহণে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা বলেছেন ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব বুদ্ধিজীবীদের তুলে নেওয়া হয়েছিল এর বেশিরভাগ ঘটনাতেই উপস্থিত ছিলেন আলবদরের চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান খান ও অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মুঈনুদ্দীন।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড
আলবদরের চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান খান। ছবি: সংগৃহীত

পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যুক্ত ছিলেন আলবদরের প্রতিষ্ঠাতা মতিউর রহমান নিজামী, সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আলী আহসান মুজাহিদ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. এহসান, ঢাকা মেডিকেলের ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান এমরান, এ বি এম খালেক মজুমদার, মওলানা আবদুল মান্নান ও আবদুল কাদের মোল্লা।

ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে আলবদর সদস্যদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছিলেন কয়েকজন বিহারী। ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় ব্যবহার করা হয়েছিল কাদালেপা মাইক্রোবাস ও ইপিসিএফের গাড়ি। গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন তাহির।

সুপরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের শেষ এক মাস ধরে চললেও মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সূচনা হয়েছিল ২৫ মার্চ কালরাতেই।

২৫ মার্চ কালরাতে ও ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে একে একে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান, ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ মুক্তাদির, গণিত বিভাগের অধ্যাপক এ আর খান খাদিম ও অধ্যাপক শরাফত আলী, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব এবং পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মুনিরুজ্জামান।

এ ছাড়াও, ২৬ মার্চ ভোরে হানাদারদের ব্রাশফায়ারে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা আহত হলেও ৪ দিন পর ৩০ মার্চ তিনি শহীদ হন।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়েই দেশব্যাপী চলেছে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। ২৯ মার্চ কুমিল্লায় অ্যাডভোকেট আবদুল করিমের নির্দেশে ভাষা সংগ্রামী ও রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তার ছেলেসহ নিজ বাড়ি থেকে উঠিয়ে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনের পর হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের ৪ এপ্রিল সকালে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক যোগেশচন্দ্র ঘোষকে।

১৪ এপ্রিল হানাদারদের গুলিতে রাজশাহীতে শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার। ১৫ এপ্রিল হানাদারদের হাতে নিখোঁজ হন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক হবিবুর রহমান।

২৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্দেশে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও নারী শিক্ষার অন্যতম অগ্রদূত নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।

২৫ মার্চ রাতে নীলফামারীর সৈয়দপুর শহর থেকে ১৫০ বুদ্ধিজীবীকে আটকের পর টানা ১৮ দিন পৈশাচিক নির্যাতনের পর ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাসের পাশে বালারখাইলে নিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। বালারখাইলই ছিল মুক্তিযুদ্ধে একক সর্ববৃহৎ বুদ্ধিজীবী গণহত্যা।

১৫ জুন দ্য ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজে প্রকাশিত 'পূর্ব-পাকিস্তানে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ' শিরোনামের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় 'পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে বেছে বেছে গণহত্যা চালাচ্ছে তা তারা প্রতিবারই অস্বীকার করছে। যদিও একের পর এক তথ্যপ্রমাণে এটি প্রমাণিত যে তারা  বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, ছাত্র—মোট কথা যারাই স্বতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিতে পারবে তাদেরকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা

বাংলাপিডিয়ার হিসাব অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশজুড়ে মোট ১ হাজার ১১১ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর বাহিনী। তাদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, ৯ জন শিল্পী ও সাহিত্যিক, ৫ জন প্রকৌশলী, এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবী ২ জন।

যদিও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের তালিকায় ৮৮ শহীদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসকের নাম পাওয়া যায়।

২০২০ সালে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রাথমিক তালিকায় শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ১ হাজার ২২২ জন। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি।

Comments

The Daily Star  | English

S Alam threatens int'l legal action against govt over asset freezing: FT

Alam says his family's bank accounts were frozen, they were subjected to travel bans, and they lost control of their companies, all while facing investigations for alleged money laundering without formal notification.

43m ago