সৌরশক্তি-বৃষ্টির পানিতে পরিবেশবান্ধব সেচ সুবিধা

পরিবেশবান্ধব সেচ ব্যবস্থা
নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ী বরদহ গ্রামে পাতকুয়ার সামনে আলুখেতের পরিচর্যায় এক কৃষক পরিবার। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

পরিবেশবান্ধব সেচব্যবস্থা এখন উত্তরাঞ্চলের অনেক কৃষকদের হাতের নাগালে। এর মাধ্যমে শস্য উৎপাদনের পাশাপাশি দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা যাচ্ছে। এখন দাবি এই ব্যবস্থা সব কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

পরিবেশবান্ধব সেচব্যবস্থায় মূলত বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা হয়। কূপ খনন করে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার পর শুষ্ক মৌসুমে সৌরবিদ্যুতের সাহায্যে পাম্প দিয়ে সেই পানি জমিতে সেচের জন্য ব্যবহার করা হয়।

কূপ থেকে সেচের পানি তোলার জন্য এর ভেতরে লম্বা পাইপযুক্ত পাম্প বসানো হয়। কুয়ার ওপরে গোল ধাতব ছাউনিতে স্থাপিত সোলার প্যানেলের সঙ্গে পাম্পটিকে যুক্ত করা হয়।

সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পাম্প দিয়ে পানি তুলে পাশের উঁচু জলাধারে রেখে সেখান থেকে নালার মাধ্যমে সেই পানি খেতে দেওয়া হয়।

এ সেচব্যবস্থায় পাম্প চালাতে ডিজেল বা পেট্রলের মতো জৈব জ্বালানি প্রয়োজন হয় না। ফলে কালো ধোয়া ও উচ্চমাত্রার শব্দও সৃষ্টি হয় না।

ব্যয়-সাশ্রয়ী হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের কাছে এ সেচব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

এই উদ্ভাবনের উদ্যোক্তা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এই সরকারি সংস্থাটি সম্প্রতি বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে 'ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুরে সেচব্যবস্থার সম্প্রসারণ' প্রকল্প চালু করেছে।

এ প্রকল্পের লক্ষ্য—পরিবেশ বাঁচিয়ে সহজ প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের কম দামে সেচ সুবিধা দিয়ে ফসলের উৎপাদন বাড়ানো।

পরিবেশবান্ধব সেচ ব্যবস্থা
নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ী বরদহ গ্রামে পাতকুয়া থেকে সৌরবিদ্যুতের সাহায্যে তোলা পানি দিয়ে ফুলকপির পরিচর্যা করেছেন এক কৃষক। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দ্য ডেইলি স্টারকে জানায়, এই প্রকল্পের আওতায় রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলায় চলতি বছরেই ৫০ বিশেষায়িত পাতকুয়া খনন করা হচ্ছে।

এর মধ্যে ৩৪ পাতকুয়া থেকে সেচ দেওয়া হচ্ছে। বাকি ১৬টি খননের কাজ এ বছরেই শেষ হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একটি কুয়া ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি বসাতে খরচ পড়ছে গড়ে ২২ লাখ টাকা।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নীলফামারী জোনের সহকারী প্রকৌশলী ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর মোহাম্মদ রুহুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাতকুয়াগুলো ১২০ ফুট পর্যন্ত গভীর। কুয়ায় সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে সবজিখেত ও ফলের বাগানে সেচ দেওয়া যায়।

'প্রকল্পটিতে বর্তমানে প্রতিটি পাতকুয়া থেকে পানি তোলার জন্য ৪ দশমিক ৮ অর্শ্বশক্তির পাম্প ব্যবহার করা হচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।

তিনি জানান, যাদের জমিতে এগুলো স্থাপন করা হয়েছে তাদেরকেই সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও সেচ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

গাইবান্ধা জেলা বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে জানান, তার আওতাধীন এলাকায় ১০ পাতকুয়া খনন করা হবে। এর মধ্যে ৬টির কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান আছে।

তিনি বলেন, 'প্রতিটি পাতকুয়ার পানি দিয়ে ৪০-৫০ বিঘা পর্যন্ত জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে।'

এ প্রকল্পের অধীনে থাকা কয়েকটি জেলা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি পাতকুয়ার ওপরে ছাতার মতো ধাতব ছাউনিতে নানান আকৃতির ৬-৭টি সোলার প্যানেল বসানো আছে। ছাদের মাঝখানে বড় ছিদ্র দিয়ে একটি পাইপ কুয়ার সঙ্গে যুক্ত। বৃষ্টির পানি এই পাইপের মাধ্যমে কুয়ায় সংরক্ষিত হয়।

সুবিধাভোগী কৃষকরা ডেইলি স্টারকে জানান, কুয়াগুলো গভীর হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানিও কুয়ায় জমা হয়। সেচের সময় কুয়ায় সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি শেষ হয়ে গেলে, জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে সেচ সুবিধা অব্যাহত রাখা সম্ভব।

রংপুর সদর উপজেলার সদ্য পুষ্করিণী গ্রামের চাষি আবুল বাতেন (৪০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা অন্যান্য এলাকার কৃষকদের মতো জ্বালানি তেল দাম বৃদ্ধি বা লোডশেডিং নিয়ে দুশ্চিন্তা করি না। সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে সেচের পানির ব্যবস্থা করি।'

নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার বেতলাগাড়ী বরদহ গ্রামের কৃষক ইউনুছ আলী (৫৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাতকুয়ার পানি দিয়ে সেচ দিই। প্রতি বিঘায় সেচ খরচ হিসেবে ঘণ্টায় ৫০ টাকা সার্ভিস চার্জ দিই। ডিজেল দিয়ে এই জমিতে অগভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দিতে অন্তত ২৫০ টাকা দরকার হয়।'

তার মতে, এই পরিবেশবান্ধব সেচব্যবস্থা প্রান্তিক চাষিদের জন্য আশীর্বাদ।

কৃষকরা ডেইলি স্টারকে জানান, এই সেচব্যবস্থায় ধোঁয়া হয় না। পাম্পের আশেপাশের গাছপালার ক্ষতি হয় না। উচ্চমাত্রায় শব্দ না হওয়ায় অন্যান্য সমস্যা হচ্ছে না।

প্রতিটি এলাকায় কৃষকদের দাবি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন পরিবেশবান্ধব এই সেচব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার ব্যবস্থা নেয়।

তারা মনে করেন, আরও বেশি কৃষককে এই সুবিধায় আনতে পারলে দেশে সেচব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে।

প্রকল্প পরিচালক হাবিবুর রহমান খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাতকুয়াভিত্তিক সেচব্যবস্থা কৃষকদের জন্য উপযোগী প্রমাণিত হওয়ায় এর পরিধি আরও বাড়ানো হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

5h ago