হাকালুকি হাওরে চলছে পরিযায়ী পাখি হত্যা, দেখার কেউ নেই

পরিযায়ী পাখি হত্যা
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় হাকালুকি হাওরের তুরোলবিলে পরিযায়ী পাখি হাতে এক কিশোর। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

শীতকালে দেশে পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম প্রিয় আবাসস্থল হাকালুকি হাওরে চলছে পাখি হত্যা। তবে যেন দেখার কেউ নেই।

যদিও জলাভূমিতে পরিযায়ী পাখি শিকার সরকারের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি জলাভূমিগুলোকে পরিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা (ইসিএ) হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, তবুও সেসব এলাকায় পাখি হত্যা চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।

শিকারিরা এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর এড়াতে হত্যার নিষ্ঠুর ও কুৎসিত পথ বেছে নিয়েছেন।

পরিযায়ী পাখি হত্যা
দেশে পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম প্রিয় আবাসস্থল হাকালুকি হাওর। ছবি: সংগৃহীত

গত রোববার মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওরের তুরোলবিলে গিয়ে দেখা যায়, বিলের পাশে মুজিবুর রহমানের বাড়িতে বস্তায় বেশ কয়েকটি পাখি। তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না।

মোবাইল ফোনে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উপজেলার জয়ফরনগর ইউনিয়নের নয়াগ্রামের নজু মিয়ার ছেলে হোসেন মিয়া বিষ দিয়ে পাখি ধরে জবাই করেছে।'

সত্যতা যাচাইয়ে হোসেন মিয়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। তিনি পাখি শিকারের কথা স্বীকার করেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ—হোসেন মিয়া ও তার দল বিষ ও জাল দিয়ে পরিযায়ী পাখি ধরছে। তারা সেসব পাখি চড়া দামে বিক্রি করছে।

নাগুড়া বিলের ইজারাদার ফয়েজ মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাকালুকি হাওরে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পাখির সংখ্যা কম।'

পরিযায়ী পাখি হত্যা
হাকালুকি হাওরে পরিযায়ী পাখি। ছবি: সংগৃহীত

'যদিও পরিযায়ী পাখি ধরা, আটকে রাখা ও হত্যা করা আইনত নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ তবুও স্থানীয় শিকারিরা হাওরের তীরে বিষের ফাঁদ ফেলেন,' যোগ করেন তিনি।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার পুসাইনাগর গ্রামের মনু মিয়া (৪৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিকারিরা সক্রিয়। কারণ, তারা পাখি ধরে ও বিক্রি করে জীবিকা নির্ভর করে।'

একই জেলার কুলাউড়া উপজেলার ভুকসিমইল গ্রামের সুহাস আহমেদ (৪১) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিলে জাল ফেলা নিষিদ্ধ থাকলেও শিকারিরা সরকারি নির্দেশ মানছেন না।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাখি শিকারি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি দলে ১০ থেকে ১৫ জন কাজ করে। স্থানীয় বাজারে পাখি বিক্রি করি। এটা লাভজনক।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর এক শিকারি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাকালুকি হাওর এলাকায় পরিযায়ী পাখি চড়া দামে বিক্রি করি। অনেকে তাদের কর্তাব্যক্তিদের উপহার হিসেবে দিতে বেশি দাম দিয়ে পাখি কেনেন। অনেকে অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রাখেন।'

পরিযায়ী পাখি হত্যা
পরিযায়ী পাখি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, সিলেট চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইন-২০১২ অনুযায়ী যে কোনো বন্যপ্রাণী হত্যা, শিকার, বিক্রি ও দখল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পাখি শুধুমাত্র প্রকৃতির সুন্দর সৃষ্টিই নয়, তারা নির্দিষ্ট এলাকার পরিবেশগত স্বাস্থ্য ও সম্পদের সূচক।'

তিনি আরও বলেন, 'হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের বেশিরভাগ দেশি প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ছাড়াও পরিযায়ী পাখির বিচরণভূমি হিসেবেও বিখ্যাত। এসব পাখি বন ও গাছপালার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।'

'আইনের প্রয়োগের অভাবের কারণে এটি ঘটে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'পাখি বিক্রি কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে।'

পরিবেশকর্মী ও বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল মোহায়মিন মিল্টন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি শীতে পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশে, বিশেষ করে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, মৌলভীবাজারের বাইক্কা বিল ও এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে আসে। শিকারিরা বিষটোপের পাশাপাশি ফাঁদ দিয়ে পরিযায়ী পাখি শিকার করে। বিশেষ করে হাওরখাল, মাইছলা, গজুয়া, নাগুয়া, পিংলা ও বাইয়াবিলে শিকারের ঘটনা বেশি ঘটে।'

পরিযায়ী পাখি হত্যা
শীতে প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে বাঁচতে নানান প্রজাতির পাখি আশ্রয় নেয় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জলাভূমিতে। ছবি: সংগৃহীত

'পাখি শিকারিরা রাত-দিন নানাভাবে ফাঁদ পেতে, বন্দুক ও জাল দিয়ে হাওরে পাখি শিকার করছে। বিষটোপ খেয়ে পাখির পাশাপাশি অনেক খামারির হাঁসও মারা যাচ্ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'শিকার করা পাখি স্থানীয় বাজারসহ বাসাবাড়িতে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। খাবারের হোটেলে এসব পাখির মাংস বিক্রি হচ্ছে।'

পাখি শিকারের বিষয়টি স্বীকার করে জুড়ী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লোকবল সংকটে অনেক সময় পাখি শিকারিদের ধরতে আমাদের বেগ পেতে হয়। তবে এ ব্যাপারে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

সিলেটের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল জব্দ করে পুড়িয়েছি।'

তিনি আরও বলেন, 'পাখি শিকার বন্ধে আমাদের প্রধান বাধা লোকবল সংকট। মাঝেমধ্যে বন্দুক দিয়ে পাখি হত্যার সংবাদ পাই। এ ব্যাপারে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এরপরও যদি কেউ পাখি শিকার করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদুর রহমান খন্দকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা পরিযায়ী পাখি শিকার হতে দিতে পারি না। হাওরে পাখি শিকারি পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাব।'

হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার ৫ উত্তর-পূর্ব উপজেলার অংশ নিয়ে ১৮১ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার জলাভূমি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এখানে ২৮৩ বিল, ১০ নদী ও অসংখ্য খাল আছে। সরকার ১৯৯৯ সালে হাকালুকি হাওরকে পরিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে।

Comments

The Daily Star  | English

Moody's downgrades Bangladesh's ratings to B2, changes outlook to negative

“The downgrade reflects heightened political risks and lower growth, which increases government liquidity risks, external vulnerabilities and banking sector risks, following the recent political and social unrest that led to a change in government,” said Moody’s.

1h ago