জাপানে থাকা ছাত্রনেতাও আসামি, ১২ দিনে বিএনপির বিরুদ্ধে ৬ মামলা
গত ১২ দিনে নাশকতার অভিযোগে পুলিশের করা তিনটি, কার্যালয় ভাঙচুর ও হামলার অভিযোগে ছাত্রলীগের করা দুটি ও শ্রমিক লীগের করা একটিসহ ৬টি মামলায় বিএনপির ১৮৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৫০০ এর বেশি জনকে আসামি করা হয়েছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুরে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুরের অভিযোগে বিএনপির ২৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ২৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন শ্রমিক লীগের মেঘনা শিল্পাঞ্চল শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল হালিম।
গত ১৮ নভেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের বন্দরে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুরের অভিযোগে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ২৪ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন মো. সোহেল নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা ওই মামলায় ২৪ জনের নাম উল্লেখসহ ২৫-৩০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।
এরপর ২১ নভেম্বর রাতে নাশকতার অভিযোগে বিএনপির ৩৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০০-২৫০ জনকে আসামি করে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা করে পুলিশ। বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে থানার উপপরিদর্শক শাহাদাত হোসেন মামলাটি দায়ের করেন।
গত ২৭ নভেম্বর সকালে নাশকতার অভিযোগে একই আইনে আড়াইহাজার থানার উপপরিদর্শক মামুন মিয়া বাদী হয়ে বিএনপির ৪৩ জনের নাম উল্লেখসহ ৫০-১০০ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। একই সকালে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় আরেকটি মামলা করে পুলিশ। নাশকতার অভিযোগে ওই মামলাতেও বিএনপির ২১ জনকে আসামি করেন থানার উপপরিদর্শক সানোয়ার হোসেন। এই মামলায় ১৫-২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
গতকাল ২৮ নভেম্বর রাতে রূপগঞ্জে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ৩৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন আশাদুল প্রধান নামে ছাত্রলীগের এক কর্মী। মারধর, মোটরসাইকেলে আগুন এবং ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে ওই মামলায় অজ্ঞাত ৭০-৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় উল্লেখিত তথ্য ও বাদীর বক্তব্যে ভিন্নতা
বন্দরে মো. সোহেল নামে ছাত্রলীগ কর্মী মামলার এজাহারে বলেন, 'নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের অধীন বন্দরের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কবিলের মোড়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়। সামনেই মামলার এক নম্বর আসামি আতাউর রহমান মুকুলের বাড়ি ও রাজনৈতিক কার্যালয়। কিছুদিন যাবত আসামিরা বাদী ও দলের লোকজনকে ডেকে তাদের পক্ষে কাজ করতে বলেন। আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ডাকা সমাবেশেও অংশগ্রহণের কথা বলে। বাদী ও তার দলের লোকজন এই বিষয়ে অসম্মতি জানালে আসামিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এরই জেরে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালায়।'
মামলায় ছাত্রলীগ কর্মী সোহেল আরও বলেন, 'আতাউর রহমান মুকুল ও নুর মোহাম্মদ পনেছের নেতৃত্বে আসামিরা কুড়াল, লোহার রড, হকিস্টিক ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। তারা ককটেল ফুটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায়। একই সময় কার্যালয়ের ড্রয়ারে থাকা বাদীর ব্যবসায়ের নগদ ৫০ হাজার টাকা ও তিনটি মোবাইল ফোন নিয়ে যায় আসামিরা।'
মামলার বিষয়ে বাদী মো. সোহেলের সাথে যোগাযোগ করা হলে এজাহারে উল্লেখিত তথ্যের সাথে তার বক্তব্যের ভিন্নতা পাওয়া যায়। মামলা রেকর্ড হয় শুক্রবার রাতে। নিজেকে ছাত্রলীগের কর্মী দাবি করা সোহেল মামলা রেকর্ডের পরদিন শনিবার দুপুরে বলেন, 'আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ৫-৬ জন লোক গেঞ্জির কাপড় দিয়ে তাদের মুখ ঢেকে আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালায়। এই সময় তাদের একজনের হাতে একটা কাঠের লাঠি ছিল। তারা চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে। অফিসের বাইরে কয়েকজন ককটেল ফুটায়। তখন আমরা দ্রুত দৌড়ে বেরিয়ে যাই। হামলকারীদের মুখে কাপড় বাঁধা থাকায় আসামিদের কাউকে চিনতে পারিনি।'
বাদীর ভাষ্য অনুযায়ী হামলাকারীদের মুখ ঢাকা থাকায় তিনি তাদের কাউকেই চিনতে পারেননি। তবে মামলায় আসামির তালিকায় ২৪ জনের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানাসহ উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাদী সোহেল বলেন, 'আমি নিজেই মামলা করেছি। আসামিদের মুখে গেঞ্জির কাপড় ছিল বলে কারও চেহারা দেখি নাই। কিন্তু আওয়ামী লীগ অফিসে বিএনপির লোকজন ছাড়া আর কে হামলা করবে? আমি ধারণা করছি বিএনপির লোকজনই হামলা করছে। ধারণা থেকেই তাদের আসামি করছি। মামলায় যারা আসামি তারা সবাই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী।'
কারও চেহারা না দেখে সন্দেহবশত আসামি করেছেন এমনটা কি মামলায় উল্লেখ করেছেন, এমন প্রশ্নের জবাব দেননি। সোহেল বলেন, 'আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরে আপনার সাথে কথা বলবো।'
এদিকে মামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মামলার এক নম্বর আসামি মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি আতাউর রহমান মুকুল বলেন, 'গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে এশা পর্যন্ত আমার বাসায় ঘরোয়া মিটিং ছিল। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো হামলা-ভাঙচুর করা হয় নাই। আমরা তো এমনিতেই নানা মামলা নিয়ে দৌড়ের উপরে আছি, আমরা আওয়ামী লীগের অফিসে ভাঙচুর করবো কোন সাহসে? তাও আবার আমার বাড়ির সামনে অফিস।'
তিনি আরও বলেন, 'শুক্রবার রাতেই মিডিয়াতে আওয়ামী লীগের নেতাদের বলতে শুনেছি, হামলাকারীদের মুখ কাপড়ে ঢাকা ছিল, কাউকে তারা চিনতে পারেননি। তাহলে মামলায় আমাদের নাম দিলো কীভাবে? আসলে এইগুলো হলো নাটক সাজিয়ে বিরোধীদলকে দমানোর চেষ্টা। আগামী ১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশে আমরা যাতে ঢাকায় যেতে না পারি সেজন্য এইসব নাটক সাজানো হচ্ছে সরকারি দলের পক্ষ থেকে। তবে এতে আমাদের দমানো যাবে না।'
প্রবাসে থাকা ছাত্রনেতা আসামি
ফতুল্লায় থানায় করা পুলিশের নাশকতার অভিযোগের মামলাটিতে ৩৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে মো. ইসহাক ইসলামকে। মামলাতে ইসহাকের পিতার নাম ও ঠিকানা উল্লেখ না থাকলেও সে 'ফতুল্লা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি' এই তথ্য উল্লেখ রয়েছে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ইসহাক ইসলাম গত ৮ মাস যাবত জাপানে রয়েছেন।
ইসহাক ইসলামের পরিবারের লোকজন জানান, নারায়ণগঞ্জ সদরের ফতুল্লার দাপা ইদ্রাকপুর এলাকার মোক্তার হোসেনের ছেলে ইসহাক। গত মার্চে পড়াশোনার জন্য জাপানে যান তিনি। গত আট মাস তিনি জাপানের কোবে শহরে রয়েছেন। কিন্তু গত ২১ নভেম্বর রাতে ফতুল্লা থানায় করা মামলায় শাহাদাত পুলিশের উপপরিদর্শক শাহাদাত হোসেন বলছেন, ইসহাক ইসলাম তার দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ ভবনের সামনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে চলাচল করা গাড়িতে ভাঙচুর ও টায়ার পুড়িয়ে, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলাচলে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করেছেন।
মামলার এজাহারে পুলিশ উল্লেখ করেছে, গত ২০ নভেম্বর চারটি হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলার আসামি জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খানকে আদালতে আনা হলে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আদালতের সামনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে অবস্থান নেয়। প্রায় ৩০০ নেতা-কর্মী জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা, যানবাহন, রাষ্ট্রয়ত্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ধ্বংসাত্মক ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সংঘটনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেকের হাতে লোহার রড, ককটেল, লাঠি-সোটা ইটপাটকেল নিয়ে সড়কে টায়ার পুড়িয়ে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা গাড়ির টায়ারে আগুন দিয়ে ও চারটি ককটেল বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে এবং চলন্ত গাড়িতে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে গাড়ির গ্লাস ভাঙচুর ও গাড়ি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে বলেও মামলায় অভিযোগ করেন এসআই শাহাদাত হোসেন। এই মামলার ৩৩ নম্বর আসামি ইসহাক।
ইসহাকের মামা সোহেল রানা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে চলতি বছরের মার্চের শেষের দিকে জাপানে পড়তে যায় ইসহাক। থাকছেন জাপানের কোবে শহরে। দেশে থাকাবস্থায় সে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি পদে ছিল। মামলার বিষয়টি আমরা শুনেছি। যে দেশে নাই তাকে আসামি করা হয়েছে জেনে আমরা অবাক হয়েছি।'
বাবার কাছে মামলায় আসামি হওয়ার কথা শুনে অবাক হয়েছেন প্রবাসে থাকা ছাত্রনেতা ইসহাক ইসলাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে প্রবাসে থাকা এই ছাত্রনেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত মার্চের শেষের দিকে পড়াশোনার জন্য আমি জাপানে চলে আসি। এইখানে ওসাকার কোবে সিটিতে আমি গত আট মাস যাবত থাকছি।'
'বাবা ফোন দিয়ে মামলার কথা জানিয়েছেন। আমার তো তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি দেশে নাই আট মাস, আর আমাকে ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের মামলা দেওয়া হইছে। মামলায় ভুল তথ্য দিয়ে আমাকে জড়ানো হয়েছে। এইভাবে গায়েবি মামলা হয় দেশে। আমি এই মুহূর্তে দেশে থাকলে তো আমার ক্যারিয়ারটাই শেষ হয়ে যেত।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিজাউল হক দিপু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এমনটা হতে পারে। আইন অনুযায়ী দেশ বা দেশের বাইরে থাকাবস্থাতেও ঘটনার সাথে যোগসূত্র থাকলে সে আসামি হতে পারে। আর এজাহারে যে ইসহাক ইসলামের কথা উল্লেখ আছে সে আর জাপানে থাকা ব্যক্তি একই কিনা তাও তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। তদন্তের পর আসলে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।'
Comments