কাতারের দোহা থেকে

বহু সংস্কৃতির মেলবন্ধন, বিবিধ আনন্দের রোশনাই 

World Cup Football Fan

সবকিছু একরকম মনে হলেও ভাষাগত মিল ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের একেকটি দেশের চরিত্র মনে হয় একেকরকম। সংযুক্ত আরব আমিরাত যেখানে আভিজাত্য আর চাকচিক্যের এক দেশ হিসেবে নিজেকে ইতিমধ্যে প্রমাণ করে ফেলেছে, সেখানে কাতার ব্যস্ত নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রমাণে। তাই বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতার নিজেদের সংস্কৃতিকে বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরার অনন্য এক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামিক আর্ট, ইসলামিক মিউজিয়াম, ইসলামিক কালচারের সঙ্গে  নিজস্ব সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য পুরো কাতারকে সাজিয়েছে তারা বিশাল আয়োজনে। সেই কাতারেই আবার বিশ্বকাপ দেখতে গিয়ে দুনিয়ার নানা প্রান্তের মানুষ নিজেদের মেলে ধরছেন বৈচিত্র্য আর নান্দিকতার ঢঙে। 

কাল একদিনে খেলা দেখলাম দুটি। প্রথমটি ছিল মরক্কো আর বেলজিয়ামের। সেই খেলায় মরক্কোর সমর্থকদের শুরু থেকেই বিশ্বাস ছিল, তারা ম্যাচটা জিতবে। গ্যালারিকে মরক্কোর পতাকার রঙে সাজিয়ে স্টেডিয়ামের গ্যালারিকে তারা মাতিয়ে রেখেছিল খেলার পুরোটা সময়জুড়েই। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য মেলে ধরার প্রয়াসে নিজেদের ভিন্নতা প্রমাণে তাদের ব্যস্ততা ছিল দৃশ্যমান। 

World Cup Football Fan

হাকিম জিয়েশ, আশরাফ হাকিমিরা মরক্কোর উজ্জীবিত দর্শকদের হতাশ করেননি। দুর্দান্ত খেলে বেলজিয়ামকে হারিয়ে তারা জন্ম দিয়েছেন এই বিশ্বকাপের আরেকটি অঘটনের। গ্যালারিতে বসে মরক্কো থেকে খেলা দেখতে আসা ফাতেমার সঙ্গে আলাপ হলো। নিজ দেশের পতাকা আর আকর্ষণীয় সাজে নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যই যেন তুলে ধরতে চাইছিল ফাতেমা। ফাতেমা মরক্কোকে সমর্থন জানাতে এসেছে মারাক্কেশ থেকে। তার বিশ্বাস, তারুণ্যে উজ্জীবিত এই মরক্কো বিশ্বকাপে অনেকদূর যাবে।  

World Cup Football Fan

প্রথম খেলা শেষ করে চলে গিয়েছিলাম ফিফা ফ্য্যন ফেস্টে। কাতার বিশ্বকাপের মূল কেন্দ্র হচ্ছে এই ফ্যান ফেস্ট। সারাবিশ্ব থেকে ফুটবল দেখতে আসা সমর্থকরা প্রতিদিন জড়ো হন এখানে। কেউ কেউ এখানে ছুটে আসেন বিয়ারের লোভে। বিশ্বকাপে একমাত্র ফ্যান ফেস্টেই মন ভরে বিয়ার বুঁদ হতে পারেন অ্যালকোহলপ্রেমীরা। গলা ভেজাতে ভেজাতে সেখানে আলাপ চলে বিশ্বকাপের নানান হিসাব নিকাশের, অনেকে রাজা উজির মেরে দিনের ক্লান্তি উড়িয়ে দিতে চান রাতের আকাশে। 

একটি ম্যাচ দেখে এসেছি ফ্যান ফেস্টে, মাঝখানের একটি ম্যাচের পর আবার অন্য আরেকটি স্টেডিয়ামে ছুটতে হবে স্পেন আর জার্মানির খেলা দেখতে। কাতার বিশ্বকাপের এই একটি সুবিধা। ছোট দেশ হওয়ার কারণে কাতারে একদিন খুব সহজেই ফুটবল প্রেমীরা দেখতে পারছেন দুটি ম্যাচ। এখানে বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ ছিল না।

World Cup Football Fan

এরইমধ্যে আলাপ হলো ব্রাজিল থেকে আসা দম্পতি অলিভিয়েরা আর জেসনের সঙ্গে। ব্রাজিল আর সুইজারল্যান্ডের ম্যাচে কে জিতবে এমন প্রশ্নে দুজনেই হেসে দিলো। তারপর জেসন জানালো- 'ব্রাজিল কি বিশ্বকাপে হারতে আসে নাকি? প্রতিটি বিশ্বকাপেই ব্রাজিল আসে টপ ফেভারিট হিসেবে। কখনো দুর্ভাগ্য, কখনো ভুল কৌশলের কারণে ব্রাজিল হেরে যায়।'

নেইমার তো পরের কয়েকটি ম্যাচ খেলবে না- এই প্রশ্নের উত্তরে অলিভিয়েরা বললো, 'এবারের ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে দলটা নেইমার বা কোনো একজন খেলোয়াড় নির্ভর নয়। এই ব্রাজিল বিশ্বকাপে এসেছে একটা দল হিসেবে। আর কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিল যে আক্রমণভাগ নিয়ে এসেছে সেই আক্রমণভাগ ঠেকানোর কেউ নেই এখানে, কোনো দল পারবে না সেই আক্রমণভাগের চাপ নিতে।'

কথার একেবারে শেষে অলিভিয়েরা হাসতে হাসতে মজা করে বললো- 'রাশিয়া যুদ্ধে ইউক্রেনকে ঠেকিয়ে দিতে পারলেও, ব্রাজিলের এই বিশ্বকাপের আক্রমণভাগকে তারাও ঠেকাতে পারবে না!'  অলিভিয়েরার এই কথা শুনে আমারও মনে হলো কথা তো সত্যিই- নেইমার, ভিনিসিয়ূস জুনিয়র, রাফিনহা, রদ্রিগো, গ্যাব্রিয়েল জেসুস, মার্টিনেল্লি, অ্যান্টনিকে নিয়ে গড়া আক্রমণভাগকে সামলানো এই বিশ্বকাপের যেকোনো দলের জন্যই সামলানো বেশ কঠিন। 

World Cup Football Fan

ফ্যান ফেস্টে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে কানাডা আর ক্রোয়েশিয়ার খেলা দেখে ছুটলাম স্পেন আর জার্মানির খেলা দেখতে। এখানে বিশ্বকাপ উপলক্ষে মেট্রো আর পাবলিক বাস  কার্ডধারী সমর্থকদের জন্য একেবারে ফ্রি। কিন্তু মেট্রো আর পাবলিক বাসে স্টেডিয়ামে যেতে হলে মানুষের ভিড়ের কারণে সময় লেগে যায় অনেক। তাই সহজে এবং কম সময়ে স্টেডিয়ামে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সিই একমাত্র ভরসা। এখানে যারা ট্যাক্সি চালায় তার বেশিরভাগই ভারতে কেরালা এবং পাকিস্তানের পেশোয়ারের। মাঝেমধ্যে কিছু বাংলাদেশি চালকের দেখাও মিলে। বাংলাদেশি ট্যাক্সি ড্রাইভার পাওয়া গেলে চলতি পথে গল্প জমে বিস্তর। কালও যেমন পেয়ে গেলাম চাঁদপুরের ইসহাককে। তিনি এখানে বাচ্চাদেরকে আরবি শিক্ষা দেন, পাশাপাশি ফাঁকা সময়ে ট্যাক্সি চালান। তার কাছেই শুনলাম, কাতারের অনেক মসজিদের ইমাম আর মুয়াজ্জিন বাংলাদেশের মানুষ। ইসহাকও মসজিদেও ইমাম হওয়ার জন্য দুবার পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু কাতারে ইমাম আর মুয়াজ্জিন নিয়োগ পরীক্ষা এতই কঠিন যে দুবার পরীক্ষা দিয়ে একবারও তিনি পাশ করতে পারেননি। আবার পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। মসজিদের ইমাম হতে পারলে কাতারে ভালো বেতন পাওয়া যায়, বিনামূল্যে বাসা পাওয়া যায়। দেশ থেকে পরিবার নিয়ে এসে এখানে রাখা যায়। সন্তানদেরকে ভালো স্কুলে পড়ালেখা করানো যায়। 

স্পেন আর জার্মানির টানটান উত্তেজনার ম্যাচে স্পেন জিততে জিততেও ম্যাচ ড্র করেছে। আর এই ড্রয়ে এখনো দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার আশা বেশ ভালোই জেগেছে জার্মানির। স্পেনের সমর্থকরা অবশ্য দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া নিয়ে আগে থেকেই নির্ভার, অন্যদিকে পরবর্তী ম্যাচে জার্মানিরও সহজ প্রতিপক্ষ। কিন্তু মাঠে উপস্থিত ব্রাজিলিয়ানরা কালকের ম্যাচে স্পেনকেই সমর্থন দিয়েছেন। কারণ, জার্মানি প্রথম রাউন্ডে বিদায় নিলে তো পথের একটা কাঁটা কমে যায়! অন্যদিকে স্পেন আর জার্মানির সমর্থকরা এই বিশ্বকাপে নিজেদের সবচেয়ে শক্ত প্রতিপক্ষ আর ফেভারিট মানছেন ব্রাজিলকেই। তাদের ভাষ্যে, ব্রাজিলের এবারের বিশ্বকাপ টিমটা এত ভারসাম্যপূর্ণ যে এই দলকে হারানো যেকোনো দলের জন্যই কঠিন। এছাড়া অভিজ্ঞ তিতের কৌশলের কাছেও হেরে যাওয়ার আশঙ্কা দেখছেন অনেকে। কারণ, তিতে ব্রাজিলকে কখন কি ফর্মেশনে খেলান এটাই এখনো ধরতে পারছে না প্রতিপক্ষের সমর্থকরা। ভাগ্য পাশে থাকলে আর প্লেয়ারদের ইনজুরি যদি বড় বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় তাহলে হেক্সা মিশনে এবার সফল হবে ব্রাজিল এটা মানছেন বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট জার্মানি আর স্পেনের সমর্থকরাও। 

আজ সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচেই হয়তো দেখা যাবে হেক্সার জন্য কতটা প্রস্তুত হয়ে কাতার বিশ্বকাপে এসেছে ব্রাজিল! 

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka airport receives 2nd bomb threat

Operations at HSIA continue amid heightened security

39m ago