‘হাজারো ছবি তুলে বুড়ো হয়েছি, আরও তুলতে চাই’
বাবার ছবি তোলার শখ ছিল। শিশু বয়সে তাই সুযোগ হয়েছিল বিদেশি নামি ব্র্যান্ডের ক্যামেরায় ছবি তোলার। জাপান থেকে আনা বাবার 'মামিয়া সিক্স' এ হাতেখড়ি।
ষাটের দশকে কিশোর বয়সে অসংখ্য ছবি তুলেছেন 'লাইকা' ক্যামেরায়। ওই ক্যামেরাটি তার বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এক মার্কিন সৈনিকের কাছ থেকে ৪০ টাকায় কিনেছিলেন।
তারপর কয়েক দশক দেশের নানান প্রান্ত ঘুরেছেন, তুলেছেন অসংখ্য ছবি। পেয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিও।
গতকাল শনিবার নারায়ণগঞ্জ শহরের আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনে আড্ডায় ৭৬ বছর বয়সী কলকাতার আলোকচিত্রী মালা মুখার্জি তার অভিজ্ঞতার কথা জানান।
নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক ক্লাব (এনপিসি) এই আয়োজন করে। এতে সংগঠনের সদস্যরা অংশ নেন।
আড্ডার শুরুতে এনপিসির যুগ্ম সম্পাদক মুনতাসির মঈন আলোকচিত্রী মালা মুখার্জি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। তিনি বলেন, ষাটের দশকের আনকোরা আলোকচিত্রী থেকে পেশাদার হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছেন মালা মুখার্জি।
১৯৮৬ সালে তাকে পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে পাওয়া যায়। তখন থেকেই দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, জার্নাল, বুক কভারে তার ছবি প্রকাশিত হতে থাকে।
১৯৯৩ সালে লন্ডনের গিল্ড হল ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাপ্লায়েড আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন স্টাডিজে গ্রাজুয়েশন করেন তিনি।
আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত এই আলোকচিত্রী দেশ-বিদেশে সম্মাননা পেয়েছেন। এককভাবে ৪৫ ও দলগতভাবে ৬৫ প্রদর্শনী করেছেন।
২০০২ সালে বিখ্যাত পাবলিকেশন 'ফাইডন' তাকে বিশ্বের ১০০ 'কনটেম্পোরারি ফটোগ্রাফার'র তালিকায় স্থান দেয়।
কথার শুরুতে মালা মুখার্জি জানালেন তার পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায়। তিনি বলেন, 'আমার যখন ২ বছর বয়স তখন বাবা জাপান থেকে কয়েকটি মামিয়া সিক্স ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলেন। সেই ক্যামেরাতেই আমার হাতেখড়ি। ছোট বয়সেই লাইকা ক্যামেরায় ছবি তুলেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কলকাতা ছেড়ে যাওয়া এক আমেরিকান সোলজারের কাছ থেকে বাবা ৪০ টাকায় ক্যামেরাটি কিনেছিলেন। ওই ক্যামেরা নিয়ে শিলং গিয়েছিলাম। ফিল্ম ভরে ছবিও তুললাম। ফিরে যখন ছবিগুলো বের করার সময় জানতে পারলাম, ফিল্মটাই ঠিকমতো লাগানো হয়নি।'
হাসতে হাসতে তিনি বলেন, 'ওইটা ছিল লাইকা ক্যামেরার প্রথম ব্যবহার। নিজে ভুল করার পর সবসময় অন্যদের বলেছি, ফিল্ম ঠিকমতো আছে কিনা সেটা দেখে নিও।'
দীর্ঘ সময়ে অনেক কাজ করলেও বিজ্ঞাপনে কাজ করেননি বলে জানান পেশাদার এই আলোকচিত্রী। নিজেকে 'স্বাধীনচেতা' হিসেবে তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, 'আমি খুবই সাধারণ লোক, সাধারণভাবেই ছবি তুলি। পুরোপুরি নিজের আনন্দে ছবি তুলি। আমি বিখ্যাত অনেকের অ্যাসাইনমেন্টও করেছি। কিন্তু, যেখানে স্বাধীনতা পেয়েছি সেখানেই কাজ করেছি, মহানন্দে ছবি তুলেছি।'
'তবে বিজ্ঞাপনের ছবি আমি কখনো তুলিনি। বিজ্ঞাপনের ছবিতে অনেক পরীক্ষা দিতে হয়। আমি অত পরীক্ষা দিতে পারি না। ছোটবেলা থেকেই পরীক্ষা দিতে আমি ভালোবাসি না,' যোগ করেন তিনি।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই দীর্ঘদিন ছবি তুলেছেন উল্লেখ করে মালা মুখার্জি জানান, 'একটি ছাগলের উঁচু হয়ে পাতা খাওয়ার' মুহূর্ত ধারণই ছিল তার প্রথম কাজ।
তিনি বলেন, 'আমার পরিবারের লোকজনই গিনিপিগ হতো। তাদের দাঁড় করিয়ে দিয়ে ছবি তুলতাম। শিক্ষিত না হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই স্বতন্ত্র্যতা ছিল। আজও যেখানে যা ভালো লাগে তাই দেখে মনের আনন্দে ছবি তুলি। মন খারাপের সময়ও ছবি তুলি।'
অনেক প্রাপ্তির মধ্যে হতাশার গল্পও শোনান তিনি। একাধিকবার না জানিয়ে বিভিন্নস্থানে ছবি ব্যবহার করার খবর পেয়ে হতাশ হয়েছেন। 'কপিরাইট আইন' নিয়ে আলোকচিত্রীদের সচেতন থাকার পরামর্শও দেন।
লন্ডনে থাকাকালে অভিজ্ঞতার কথাও জানান মালা মুখার্জি। 'বাংলাদেশ ও কলকাতার চেয়েও বড় ইলিশ সেখানে খেয়েছি,' বলেন তিনি।
পাঠাগারের পঞ্চম তলার 'পরীক্ষণ হলে' চলছিল এই আড্ডা। কথার ফাঁকে ফাঁকে মালা মুখার্জির তোলা কিছু আলোকচিত্রী প্রদর্শিত হচ্ছিল পেছনের পর্দায়। সেসব ছবির প্রেক্ষাপটও বর্ণনা করছিলেন তিনি। অধিকাংশ আলোকচিত্রই পুরনো ভবন ও দেয়ালের। এই 'সাবজেক্টের' প্রতি অনুরাগের কথাও অকপটে স্বীকার করেন তিনি। আড্ডায় আলোকচিত্র নিয়ে দু'একজনের প্রশ্নের উত্তরও দেন।
আড্ডার শেষদিকে মালা মুখার্জি বলেন, 'হাজার হাজার ছবি তুলেছি। এখন বুড়ো হয়ে গেছি তো। তারপরও ছবি তুলে যেতে চাই। যেখানে আগে ছবি তুলেছি, সেখানে আবারও যাই। আগের মতো পাই কিনা খুঁজি। কিন্তু, কিছুই আর আগের মতো থাকে না। কেউই থাকে না।'
আয়োজনের দ্বিতীয় পর্বে আলোকচিত্রের ওপর 'ফটোগ্রাফিক বুক শো' চলে। এতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আলোকচিত্রীর দুর্লভ বই দেখানো হয়। এই ধরনের 'বুক শো' নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছে বলে দাবি জয় কে রায় চৌধুরীর।
Comments