শ্রদ্ধা

রাজা যায় রাজা আসের কবি আবুল হাসান

অন্তহীন স্বপ্নচারিতার কবি আবুল হাসান। মাত্র ঊনত্রিশ বছরের জীবনবৃত্তে যিনি বুনন করেছেন অমরত্বের পরিপুষ্ট শিল্পবীজ। যার স্বাতন্ত্র্য শিল্পী-সত্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনবোধ খুব দ্রুতই অনুভব করা যায় তার মাত্র দুটো স্তবকের মাধ্যমে : 'শিল্প তো স্বাতীর বুকে মানবিক হৃৎপিণ্ড, তাই/ আমি তার হৃৎপিণ্ডে বয়ে যাই চিরকাল রক্তে আমি/ শান্তি আর শিল্পের মানুষ।' [রাজা যায় রাজা আসে, ১৯৭২] কিংবা 'ঝিনুক নীরবে সহো/ ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!' [পৃথক পালঙ্ক, ১৯৭৫]। যেখানে শান্তি আর শিল্পের মানুষ আবুল হাসান হয়ে ওঠেন মানবিক হৃৎপিণ্ডের কবি।

আত্মগত দুঃখবোধ, মৃত্যুচেতনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিঃসঙ্গচেতনা, স্মৃতিমুগ্ধতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবুল হাসানের কবিতায় সার্থকভাবে প্রতিফলিত। তার সম্পর্কে কবি শামসুর রাহমান বলেন, 'তিনি যৌবনের বিষণ্ণতা, নিঃসঙ্গ এবং দীর্ঘশ্বাসের কবি। তাঁর শিল্প-সৌন্দর্য বোধ যেমন তীক্ষ্ণ তেমনি তীব্র মানুষের প্রতি তাঁর মমতা, জীবনের প্রতি ভালোবাসা।' তার অনুজ কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ভাষায়, 'একটি জন্মান্ধ এবং দিব্যদৃষ্টিরহিত সময়ে তার কবিতার উন্মোচন। যখন কবিতা যৌনতা, অনিকেতচেতনা ও আত্মধ্বংসী স্বমেহনের আময়কে গিলে গিলে ফেঁপে উঠেছিল, তখন তিনি তাঁর অন্তহীন স্বপ্নচারিতা নিয়ে আসেন। হাসানের রক্তের ভেতরেই ছিল একটি বাউল ও একজন স্বাপ্নিক।'

আবুল হাসান একজন বাউল, শান্তিপ্রিয় অন্তর্মুখী কবি এবং ব্যথা-বিষকে নীরবে সহ্য করে মুক্তা ফলানোর নিরন্তর সাধক হলেও তার প্রতিবাদী ও দ্রোহী সত্তা তার কবিতার শ্রেষ্ঠ ভূষণ। এক্ষেত্রে তিনি রুগ্ন ও আধ্যাত্মিক নন, তিনি আত্মচেতন, আত্ম-অস্তিত্ব সচেতন এবং আত্মানুসন্ধান ও আত্মস্বীকৃতির প্রশ্নে সরব ও সাহসী। এর বড় প্রমাণ তার রাজা যায় রাজা আসে শীর্ষক প্রথম কাব্য।

যে কবিতার নাম 'আবুল হাসান'। কবির স্বনাম-ই যে কবিতার নামকরণ হতে পারে, আবার সেই কবিতা যে গ্রন্থের প্রথম কবিতা হতে পারে, ভাবব্যঞ্জনা ও দার্শনিক চৈতন্যে সে-কবিতাই যে কাব্যগ্রন্থের মূল কবিতার গৌরব অর্জন করতে পারে, তা কবি আবুল হাসানের কাছ থেকেই আমাদের জানতে হয়, জেনে নিতে হলো।

আমিত্ব, আত্মানুসন্ধান, আত্ম-স্বরূপোন্মোচনার শৈল্পিক সমাবেশ ঘটেছে 'আবুল হাসান' কবিতায়। এতে রয়েছে চারটি স্তবক বা অংশ; যথা :

১ম স্তবক :

সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,
মায়াবী করুণ- এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?
এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা?
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ?
মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর
কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর?

২য় স্তবক :

আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছি নিজেকে,
যারা খুব হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে, যারা এঘরে ওঘরে যায়
সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্দর প্রহরী
তারা কেউ কেউ বলেছে আমাকে–
এটা তোর জন্মদাতা জনকের রুগ্ন রূপান্তর,
একটি নামের মধ্যে নিজেরি বিস্তার ধরে রাখা,
তুই যার অনিচ্ছুক দাস!

'আবুল হাসান' কবিতায় ব্যবহৃত সংকেত-শব্দসমূহ হচ্ছে পাথর, লাবণ্য, মায়াবী করুণ, নদী, উপগ্রহ, রাজা, কান্না ভেজা চোখ, সময়ের সাহসী সন্তান, সভ্যতার সুন্দর প্রহরী, জন্মদাতা জনক, রুগ্ন রূপান্তর, অনিচ্ছুক দাস, যুদ্ধ, দুরন্ত চাঁদ, নীল দীর্ঘশ্বাস, মানুষ, ভালোবাসা, ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর স্কুল। এ-কবিতায় কবিকে নির্দেশ করে পাথর, লাবণ্য, মায়াবী করুণ, নদী, উপগ্রহ ও রাজা ইত্যাদি।

কবির বৈরী-জীবনরূপ : কান্না ভেজা চোখ, রুগ্ন রূপান্তর, অনিচ্ছুক দাস, যুদ্ধ, নীল দীর্ঘশ্বাস। কবির স্বজন: সময়ের সাহসী সন্তান ও সভ্যতার সুন্দর প্রহরী। আর, কবির আরাধ্য : ভালোবাসা, ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর স্কুল। এসব শব্দ-সংকেত ও শ্রেণিসূত্রকে বিবেচনায় নিলে 'আবুল হাসান' কবিতার সারবস্তু বা তত্ত্বকথা দাঁড়ায় : আত্ম-অস্তিত্ব ও আত্ম-স্বরূপ অনুসন্ধানী কবি তার নিজের নামের মধ্যে কল্পনা ও বাস্তবতার সমন্বয় ঘটিয়ে মানুষের জীবনের গূঢ়ার্থকে উন্মোচন করেছেন। 

জীবন কী, জীবনের অন্বিষ্ট ও আরাধ্য কী, জীবনের গতিপথ কেমন, জীবনের ধারাক্রম কীরূপ, জীবনের দায়বোধ কীসে ইত্যাদি বহু দিনের বহু প্রশ্নের উত্তরে তিনি তার আত্মা বা স্বজনস্বরূপ সময়ের সাহসী সন্তান ও সভ্যতার সুন্দর প্রহরীদের কাছে জেনেছেন যে, জীবন মানে উত্তরসূরি, জীবন অর্থ উত্তরাধিকার, জীবন হলো 'জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ন রূপান্তর'; যে জীবনে পৃথক বা স্বতন্ত্র সত্তায় বিশিষ্ট 'ব্যক্তি-আমি' জন্মদাতা জনকের আজন্ম দাস নন, অনিচ্ছুক দাস।

'আবুল হাসান' কবিতার সারবস্তু বা তত্ত্বকথার বিবিধ দিকসমূহ হলো : ক. ব্যক্তি-মানুষ একটি নাম নিয়ে পৃথক ও পরিচিত হয়। খ. ব্যক্তি-মানুষ তার নামের মধ্যে কিংবা নামের বৃত্তে পরিবর্ধিত ও বিকশিত হয়। গ. ব্যক্তি-মানুষ তার জন্মদাতা জনকের উত্তরাধিকার বহন করে। ঘ. ব্যক্তি-মানুষ তার পূর্বসূরি জনকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে জীবনধারা সম্পন্ন করে। এবং ঙ. ব্যক্তি-মানুষ বস্তুত উত্তরাধিকার সূত্রে দাস, সে পূর্বসুরিদের দাসত্ব করে; কিন্তু, তার পৃথক ও স্বতন্ত্র সত্তার কারণে কখনো আজন্ম দাস হয় না, সে হয় 'অনিচ্ছুক দাস'।

'আবুল হাসান' কবিতাটি রাজা যায় রাজা আসে কাব্যগ্রন্থের প্রধানতম কবিতা। স্বাধীন বাংলাদেশের আলোছায়ায় ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিলো। উৎসর্গপত্রে লেখা ছিলো : 'আমার মা/ আমার মাতৃভূমির মতোই অসহায়'। প্রধানতম কবিতা, কাব্যগ্রন্থের নামকরণ, উৎসর্গ ও প্রকাশকাল এবং এসবের সঙ্গে কবি আবুল হাসানের জন্মস্থান বিবেচনায় নিলে কবিতাটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অন্যভাবেও হতে পারে; যা ইতিহাসচেতনা ও আর্থরাজনৈতিক জীবনাভিজ্ঞতায় অন্য কবিদের থেকে তাকে স্বতন্ত্র করবে কিংবা করেছে।

জীবনের গূঢ়ার্থ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মানবজীবন, বিশ্বরাজনীতি ও বিশ্বসভ্যতা অবলোকন করেছেন কবি আবুল হাসান। যেখানে মানুষের পরিচয় হচ্ছে একজন 'অনিচ্ছুক দাস'। যে-কারণে একাত্তুরের মহান স্বাধীনতাও তার চেতনায় রাজাবদল মাত্র। মানবসভ্যতায় সাধারণ মানুষের শেষ পর্যন্ত মুক্তি নেই, স্বীকৃতি নেই, স্বাধীনতা নেই। কিন্তু, দাসত্ব তার কাম্য নয়। আলোকিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ও সর্বৈব স্বাধীনতার বাসনায় একজন আত্মচেতন বিশ্বমানুষের যে অধিকারচৈতন্যের আর্তি ও গোপন আর্তনাদ, তা আবুল হাসানে বিশেষ মাত্রা পেয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

The wrongs of past 15yrs must be righted

The Daily Star spoke to BNP Secretary General Mirza Fakhrul Islam Alamgir on a host of issues ranging from elections to media freedom 

14h ago