কুমিল্লা ভ্রমণে যেতে পারেন যে ১০ দর্শনীয় স্থানে

কুমিল্লা ভ্রমণে যেতে পারেন যে ১০ দর্শনীয় স্থানে
কুমিল্লায় অবস্থিত শালবন বিহার। ছবি: ইউএনবি

কুমিল্লা জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ সমৃদ্ধ শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত ঐতিহাসিক এই জেলাটি সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীর বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আশ্রয়স্থল। অনেক অনেক আগে এই জেলা সমতট জনপদের অংশ ছিল। কালক্রমে এটি ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত হয়। কুমিল্লা নামটি এসেছে কমলাঙ্ক শব্দ থেকে, যার অর্থ পদ্মের পুকুর।

কুমিল্লার পর্যটন আকর্ষণগুলোর মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হয় বাংলাদেশ। এখানে অবস্থিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈন্যদের কবরস্থানটি কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন দ্বারা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। আজকের নিবন্ধটি এই গুরুত্বপূর্ণ জেলা কুমিল্লার ১০টি প্রসিদ্ধ দর্শনীয় স্থান নিয়ে।

শালবন বৌদ্ধ বিহার

এক সময়কার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রধান উপাসনালয় শালবন বৌদ্ধ বিহারের অবস্থান কুমিল্লার কোটবাড়িতে। এখানকার বনে প্রচুর পরিমাণে শাল গাছ থাকায় স্বভাবতই বিহারটির শালবন বিহার নাম হয়েছে। বিহারে মোট ১৫৫টি কক্ষ আছে, যেখানে ধর্মচর্চা করতেন বুদ্ধের অনুসারিরা।

এই বিহার থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রোঞ্জ ও মাটির মূর্তি, সিলমোহর, ৮টি তাম্রলিপি এবং অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা পাওয়া গেছে। কুমিল্লা সদর থেকে ২০ টাকা সিএনজি ভাড়ায় কোটবাড়ি বিশ্বরোড হয়ে সরাসরি শালবন বিহার যাওয়া যায়।

ময়নামতি জাদুঘর

কুমিল্লার ঐতিহাসিক নিদর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা এই ময়নামতি জাদুঘর, যার অবস্থান কুমিল্লা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে সালমানপুরে। জাদুঘরের ৪২ টি ভিন্ন ভিন্ন সংরক্ষণাগার ঘুরে দেখার সময় চোখে পড়বে ব্রোঞ্জ ও পাথরের ছোট-বড় মূর্তি, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রোঞ্জের বিশাল ঘণ্টা, পোড়ামাটির ফলক, মাটির খেলনা, কাঠের পুরানো জিনিসপত্র, মৃৎশিল্প সামগ্রী এবং প্রাচীন হাতে লেখা পান্ডুলিপি।

ময়নামতি জাদুঘর। ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লার চারপত্র, রূপবান ও কোটিলা মুড়া, শ্রীভবদের মহাবিহার, ইটাখোলা, রানির বাংলা ও ভোজ রাজবাড়ি বিহার এবং আনন্দ বিহার খননকালে খুঁজে পাওয়া যায় এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। আঙ্গিনার বিশ্রামাগার আর ফুল বাগান জাদুঘরের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ১৯৬৫ সালে কোটবাড়ির শালবন বিহারের পাশেই স্থাপন করা হয় এই জাদুঘর। পাশাপাশি হওয়ায় এক সাথে দুটো স্থানই ঘুরে আসতে পারেন পর্যটকরা।

ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহীদ হওয়া ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার সৈনিকদের একটি আন্তর্জাতিক সমাধিক্ষেত্র এই ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। ২৪ জন জাপানি যুদ্ধবন্দি ও একজন বেসামরিক ব্যক্তি সহ মোট ৭৩৭ জন সৈন্যের কবর আছে এই সমাধিক্ষেত্রে। কমনওয়েলথ পরিচালিত ওয়ার সিমেট্রিটির অবস্থান ময়নামতি সাহেব বাজার এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের টিপরা বাজারের মধ্যস্থলে।

প্রায় ৪ দশমিক ৫ একর পাহাড়ি ভূমির ওপর গড়ে তোলা ওয়ার সিমেট্রি বাংলাদেশের দ্বিতীয় কমনওয়েলথ সমাধিক্ষেত্র। স্থানীয় নিবাসীরা একে ইংরেজ কবরস্থান নামে ডাকলেও এখানে সমাহিত সৈন্যদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও ইহুদিও রয়েছেন। কুমিল্লা থেকে সিএনজি-অটোরিক্সা কিংবা বাসে করে পৌছা যায় ময়নামতির এই যুদ্ধের গোরস্থানে।

ধর্মসাগর দীঘি

কুমিল্লা সদরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই দর্শনীয় স্থানটি। আঙ্গিনায় ঢুকতেই দেখা যায় একটি সাইনবোর্ড, যেখানে লেখা আছে এই দীঘির ইতিহাস। ১৭৫০ থেকে ১৮০৮ সালে রাজা ধর্মপালের শাসনামলে রাজ্যে এক ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন পাল বংশের এই জনদরদী রাজা প্রজাদের কষ্ট দূর করার জন্য খনন করে দেন ধর্মসাগর দীঘিটি। অতঃপর তার নামেই দীঘিটি প্রসিদ্ধি লাভ করে।

দীঘির উত্তরে সবুজে ঘেরা শিশুপার্ক থেকে ধর্মসাগরের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। পর্যটকদের কেউ ধর্মসাগরের পাড় ধরে হেটে বেড়ান, কেউ বা নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ান দীঘির জলে। কুমিল্লার শাসনগাছা থেকে স্থানীয় যে কোন যানবাহন নিয়ে বাদুরতলা পর্যন্ত গেলেই দেখা যাবে ধর্মসাগর।

নব শালবন বিহার

কুমিল্লার প্রাচীন নিদর্শনের এক নতুন সংযোজন কোটবাড়ি এলাকার এই বিহারটি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শান্তি বিহার নামে পরিচিত এই বিহারটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৯৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। এখানকার মূল আকর্ষণ আপাদমস্তক ধাতুতে মোড়া প্রায় ৬ টন ওজনের ৩০ ফুট উচ্চতার সোনালী রঙের বুদ্ধের মূর্তি। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ধর্মীয় ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এটি বাংলাদেশকে উপহার দেয়া হয়।

এই বিহার পরিদর্শন করতে হলে কোটবাড়ি বাস স্ট্যান্ড থেকে সিএনজি-অটোরিকশা দিয়ে বিহার পর্যন্ত যেতে হবে। এ ছাড়া কুমিল্লা জিরো পয়েন্ট থেকে কান্দিরপাড় সড়ক দিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়া যায়। সেখানে বামের রাস্তা ধরে কিছু দূর গেলেই নব শালবন। একই পথে ফেরার সময় কান্দিরপাড় থেকে মনোহরপুর গেলেই মিলবে কুমিল্লার বিখ্যাত মাতৃভান্ডারের রসমালাই।

শালবন বিহার। ছবি: সংগৃহীত

ইটাখোলা মুড়া

কোটবাড়ির এই স্থানটি মূলত সপ্তম বা অষ্টম শতকে নির্মিত একটি বৌদ্ধ বিহার। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে ইট পোড়ানো হয় বিধায় জায়গাটির নাম হয়েছে ইটাখোলা মুড়া। ইটাখোলা মুড়ায় প্রবেশ করে উপরে উঠে গেলে চতুর্ভূজাকার ক্ষেত্রের মাঝে দেখা যায় বিহারের প্রধান মন্দিরটি।

ইটাখোলা মুড়া থেকে এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে ১৮ তোলা ওজনের স্বর্ণ, রৌপ্য মুদ্রা, মাটির পাতিলে রক্ষিত সোনার বল, ধ্যাণী বুদ্ধ মূর্তির আবক্ষ অংশ, তাম্রশাসন, মাটির ফলকলিপি, ধাতব ধ্যানীবুদ্ধ অক্ষোভ্য, ধাতব ধ্যানীবুদ্ধ অমিতাভ, অলংকৃত পোড়া মাটির ফলক, গণেশ মূর্তি ও তেলের প্রদীপ।

কোটবাড়ি বাস স্ট্যান্ড থেকে সিএনজি কিংবা অটো রিকশাযোগে ইটাখোলা মুড়া যাওয়া যায়।

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি

গাছ-গাছালি ও ফুল বাগানে সুসজ্জিত কোটবাড়ির এই স্থাপনাটি মূলত একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৯ সালের ২৭ মে প্রতিষ্ঠার সময় এটির নাম ছিলো পাকিস্তান গ্রাম উন্নয়ন একাডেমি। পরবর্তীতে পল্লী গবেষক ড. আখতার হামিদ খান এটিকে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি নাম দেন, সংক্ষেপে যেটি বার্ড নামে সুপরিচিতি লাভ করে।

প্রায় ১৫৬ একরের বিশাল জায়গায় রয়েছে ৫টি হোস্টেল, হেলথ ক্লিনিক, ৪টি কনফারেন্স রুম, মসজিদ, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, লাইব্রেরি, একটি প্রাইমারি স্কুল ও দু'টি ক্যাফেটেরিয়া। বিশেষ অনুমতি নিয়ে এখানে পিকনিক করার সু-ব্যবস্থা আছে। কোটবাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে হেটেই বার্ড-এ পৌঁছা যায়।

রূপবান মুড়া

কোটবাড়িতে ইটাখোলা মুড়ার ঠিক উল্টো পাশের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাটির নাম রূপবান মুড়া। রহিম ও রূপবানের ভালোবাসার কিংবদন্তিতে প্রচলিত আছে এই ঐতিহাসিক স্থান ঘিরে। ৯০-এর দশকে কুমিল্লা-কালিবাজার সড়কের কাছে আবিষ্কৃত হয় এই প্রত্নস্থানটি। এখানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সপ্তম থেকে ১২শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়।

রূপবান মুড়ার উঁচু বিহারের উপর থেকে সূর্যাস্তের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার জন্য কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে ভীড় জমান পর্যটকরা। কোটবাড়ি বাস স্ট্যান্ড থেকে যেতে হবে কুমিল্লা-কালির বাজারের পথে। এরপর দক্ষিণ দিকে বিজিবি ও বার্ডের মাঝখানে টিলার ওপর দেখা যাবে নয়নাভিরাম রূপবান মুড়া।

রানি ময়নামতির প্রাসাদ

কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক ধরে পূর্ব দিকে কমনওয়েলথের ওয়ার সিমেট্রি থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার গেলেই দেখা যাবে এই প্রাসাদ। এই পুরাকীর্তিটির নির্মাণকাল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝের কোনো সময়। সে সময় চন্দ্র বংশের রাজা মানিক চন্দ্র তার স্ত্রী ময়নামতির আরাম আয়েশের জন্য বানিয়ে দেন এই প্রাসাদ।

১৯৮৮ সালে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩ মিটার গভীরে থাকা একটি সুড়ঙ্গের সামনে খননের সময় আবিষ্কৃত হয় এই প্রাসাদ। প্রতি বৈশাখের সপ্তম দিন থেকে এখানে মাসব্যাপী উদযাপন হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৈশাখী মেলা।

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট গেইট অথবা কোটবাড়ি বিশ্বরোড থেকে অটোরিকশা নিয়ে ময়নামতি সাহেব বাজার গেলেই দেখা পাওয়া যাবে এই প্রাচীন প্রাসাদের।

আনন্দ বিহার

কোটবাড়ির ময়নামতিতে অবস্থিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এই বিহারটি ছিলো উপমহাদেশের সর্বশেষ বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়। এটি নির্মাণ করেছিলেন দেব রাজবংশের তৃতীয় শাসক শ্রী আনন্দ দেব সপ্তম অথবা অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে। ধারণা করা হয়, সপ্তম শতকের শেষ সময়ে এই বিহার ছিল সমতটের রাজধানী।

নান্দনিক বর্গাকৃতির বিশাল অবকাঠামোর ঠিক মাঝখানে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দির এবং অপরূপ এক দিঘি। কুমিল্লা সদর থেকে কোটবাড়ির আনন্দ বিহার যাবার পথে বিখ্যাত টমছম ব্রিজ দেখে নেওয়া যেতে পারে।

ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাওয়ার উপায়

ঢাকা থেকে বাসে অথবা ট্রেনে করে কুমিল্লা যাওয়া যায়। সায়েদাবাদ কিংবা কমলাপুর থেকে বাস যোগে কুমিল্লা যেতে খরচ পড়তে পারে জনপ্রতি ২২০ থেকে ৩৫০ টাকা। এই যাত্রায় সময় নিবে মাত্র আড়াই ঘণ্টা। এ ছাড়া চট্টগ্রামগামী প্রায় সব ট্রেনই কুমিল্লা স্টেশনে যাত্রী নামায়। ট্রেনের সিটের ধরন ভেদে ভাড়া জনপ্রতি ১৭০ থেকে ৪৬৬ টাকা।

ঢাকার খুব কাছে হওয়াতে কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে অনেকগুলোই এক দিনে ঘুরে আসা যায়। আর এ জন্যেই একদিনের ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে ঢাকাবাসীদের কাছে কুমিল্লা অনেক জনপ্রিয়। এরপরেও ভালোভাবে পুরো জেলাটি ঘুরে দেখার জন্য হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে যাওয়া উচিত। তাছাড়া ঝটিকা সফরে অনেক ছোট ছোট সৌন্দর্য্য চোখ এড়িয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকের জন্য তা ক্লান্তিকরও বটে। তাই ঢাকার নিরন্তর যান্ত্রিকতা থেকে বেরিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে কয়েকটি দিন কুমিল্লায় কাটিয়ে আসা যেতে পারে।

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

3h ago