যেভাবে নাম হলো ‘পরীর পাহাড়’

ব্রিটিশ সরকার ১৮৮৯ সালে জমিদার অখিল চন্দ্র সেনের কাছ থেকে পরীর পাহাড় অধিগ্রহণ করে এবং ১৮৯৩-১৮৯৪ সালে ওই পাহাড়ের চূড়ায় ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করে। ছবি: স্টার

চট্টগ্রাম বিভাগ ও চট্টগ্রাম জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্রের অবস্থান একটি পাহাড়ের চূড়ায়। এটি 'পরীর পাহাড়' নামে পরিচিত।

চট্টগ্রাম আদালত ভবন, বিভাগীয় কমিশনার ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এই পাহাড়ে হওয়ায়, প্রতি কর্মদিবসে এখানে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। তবে এলাকাটি অতীতে এখনকার মতো সরব ছিল না।

একসময় এ পাহাড়ের চূড়া ও সংলগ্ন এলাকায় সুনসান নীরবতা বিরাজ করত।

সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনুপম সেনের জন্মস্থান চট্টগ্রামে। 'পরীর পাহাড়' সম্পর্কে জানতে চাইলে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আগে চট্টগ্রাম শহরটি অনেক পাহাড়, টিলা এবং গভীর জঙ্গলে ঘেরা ছিল। ১৯৪০ এর দশকে আমাদের শৈশবকালেও মাত্র লাখ দুয়েক মানুষ এই শহরে বাস করত।'

একসময় এ পাহাড়ের চূড়া ও সংলগ্ন এলাকায় সুনসান নীরবতা বিরাজ করত। ছবি: স্টার

'সে সময় আন্দরকিল্লা থেকে চকবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত শহরটি খুব ছোট ছিল। ১৭৬১ সালে ব্রিটিশরা চট্টগ্রাম দখল করার আগে আন্দরকিল্লা ছিল শহরের কেন্দ্রস্থল,' বলেন ড. অনুপম।

চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর ড. অনুপম বলেন, 'একসময় লালদীঘি সংলগ্ন এই পরীর পাহাড় ছিল নীরব নিস্তব্ধ। পরবর্তীতে ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশরা এই পাহাড়ের চূড়ায় আদালত এবং অন্যান্য সরকারি অফিস স্থানান্তর করে। তখন এটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়।'

'আগে আদালত এবং সরকারি অফিস ছিল চকবাজারের কাছে বর্তমান সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের পাহাড়ের চূড়ায়। এরপর থেকে পরীর পাহাড় চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ও বিচারিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়,' বলেন তিনি।

প্রশ্ন আসতে পারে, কেন পাহাড়টি 'পরীর পাহাড়' নামে পরিচিত?     

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. অনুপম বলেন, 'পাহাড়ের চূড়ায় এক সময় পরীরা থাকত বলে একটা মিথ আছে। মানুষ বিশ্বাস করত যে জিন ও পরীরা একসময় চট্টগ্রামে রাজত্ব করত।'

'এই মিথ থেকে পরীর পাহাড় নামটি এসেছে,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'ওই সময় চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর কোনো আনুষ্ঠানিক নাম ছিল না। মানুষ লালদিঘী সংলগ্ন পাহাড়কে পরীর পাহাড় বলে ডাকত। কারণ তারা বিশ্বাস করতো পাহাড়ের চূড়ায় পরী ছিল।'

'তারই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ শাসনামলেও পাহাড়টিকে ''ফেয়রি (fairy) হিল" বলা হতো,' বলেন তিনি।

একই কথা জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৯৫০ এর দশকে চট্টগ্রাম শহরের আয়তন ছিল মাত্র ১৬ বর্গমাইল। আমি ১৯৫৩ সালে এই শহরে স্কুল যাওয়া শুরু করি। শহরটি তখন বেশ কয়েকটি পাহাড়, টিলা এবং জঙ্গলে ঘেরা ছিল।'

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মান্নান আরও বলেন, 'চট্টগ্রামের অনেক পাহাড়ের মধ্যে পরীর পাহাড় একটি। এটি ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে।'

পরীর পাহাড়ের নামকরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'স্থানীয়রা পাহাড়ের এমন নাম দিয়েছে। একটি কিংবদন্তি আছে যে পাহাড়ের চূড়ায় একসময় পরীরা বাস করত। তাই মানুষ পাহাড়টিকে এই নামে ডাকা শুরু করে।'

কী সেই কিংবদন্তি

বলা হয়ে থাকে, চতুর্দশ শতাব্দীতে পাহাড় ও টিলাবেষ্টিত চট্টগ্রাম ঘিরে ছিল নানা গল্প। মায়েরা তাদের বাচ্চাদের পরীর গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতো। লালদীঘি এলাকার পাশের পাহাড় যা আজকের পরীর পাহাড় তাই নিয়ে নানা গল্প লোকমুখে ছড়াতে থাকে।

ব্রিটিশ শাসনামলে পরীর পাহাড়ের মালিক ছিলেন পর্তুগিজ নাগরিক জন হ্যারি। পরে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন টেক্সরা হ্যারির কাছ থেকে পাহাড়টি কিনে নেন। এরপর পেরেডা নামের এক ভদ্রলোক টেক্সরা থেকে পাহাড়টি কেনেন।

পরে চট্টগ্রামের পটিয়া মহকুমার ছানহরা গ্রামের জমিদার অখিল চন্দ্র সেন ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ৯ হাজার টাকায় পেরেডার কাছ থেকে পাহাড়টি কিনে নেন।   

ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কেন্দ্রটি প্রাথমিকভাবে মাদ্রাসা পাহাড়ের (বর্তমান সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ পাহাড়) চূড়ায় অবস্থিত ছিল। সে সময় মাদ্রাসা পাহাড়ের চূড়ায় আদালত ভবন ও প্রশাসনিক অফিস ছিল।     

পরবর্তীতে নতুন শহর দক্ষিণে বিস্তৃত হলে ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক অফিস ও আদালত অন্য জায়গায় স্থানান্তরের পরিকল্পনা করে। এ লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৮৮৯ সালে জমিদার অখিল চন্দ্র সেনের কাছ থেকে পরীর পাহাড় অধিগ্রহণ করে এবং ১৮৯৩-১৮৯৪ সালে ওই পাহাড়ের চূড়ায় ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করে।

পরে মাদ্রাসা পাহাড় থেকে আদালত ও অন্যান্য প্রশাসনিক অফিস সেখানে স্থানান্তর করা হয়।

সূত্র:   ১. আব্দুল হক চৌধুরীর লেখা বন্দরশহর চট্টগ্রাম

         ২. পূর্ণ চন্দ্র চৌধুরীর লেখা চট্টগ্রামের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)

         ৩. নবীন চন্দ্র সেনের লেখা আমার জীবন (তৃতীয় খণ্ড)

Comments

The Daily Star  | English

Fire service & civil defence: High-risk job, low pay

Despite risking their lives constantly in the line of duty, firefighters are deprived of the pay enjoyed by employees of other departments, an analysis of their organograms shows.

6h ago