‘মাদকরাজ্যে’ শাহীনের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার গল্প ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

রাশেদুল ইসলাম শাহীন
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে টানানো ব্যানারের উপরে ডান পাশে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক) ও তার ছেলে গোলাম মর্তুজা পাপ্পা গাজীর ছবি। একটু নিচে বামে রয়েছে সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে আটক কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান বজলুর রহমানের ছবি। নিচের অংশে এক সারিতে স্বপন বেপারী, রাজু আহম্মেদ রাজা, রাশেদুল ইসলাম শাহীন (কালো বক্সে মার্ক করা), মো. মোস্তফা, ফাহাদ আহম্মেদ শাওন ও উজ্জ্বল আহমেদের ছবি। ছবি: স্টার

বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যাকাণ্ডের পর নতুন করে আলোচনায় আসা চনপাড়ার অবস্থান নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নে। 'মাদকরাজ্য' হিসেবে পরিচিত এই গ্রামের ৩ দিকে নদী, একদিকে খাল। যে কারণে মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এই এলাকায় সড়কপথে ঢোকার একমাত্র উপায় ডেমরা হয়ে বালু নদের ওপর নির্মিত সেতু পার হওয়া।

এই সেতু পার হয়ে খানিকটা এগিয়ে চনপাড়া মোড়ে একটি বড় ব্যানার চোখে পড়ে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে ব্যানারটি টানানো হয়েছিল। এর উপরের অংশে ডান পাশে আছে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক) ও তার ছেলে গোলাম মর্তুজা পাপ্পা গাজীর ছবি। একটু নিচে বাম পাশে কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান বজলুর রহমানের ছবি, যাকে সম্প্রতি আটক করেছে র‌্যাব।

এর নিচের অংশে এক সারিতে স্বপন বেপারী, রাজু আহম্মেদ রাজা, রাশেদুল ইসলাম শাহীন, মো. মোস্তফা, ফাহাদ আহম্মেদ শাওন ও উজ্জ্বল আহমেদের ছবি। ব্যানারের ছবিতে থাকা বজলুর রহমান থেকে শুরু করে উজ্জ্বল আহমেদ পর্যন্ত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে চনপাড়ায় মাদক ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীন ফারদিন হত্যার বিষয়টি সামনে আসার পর গত ১০ নভেম্বর দুপুরে র‌্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি ও মাদক সংশ্লিষ্টতার ২৩টি মামলার থাকার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

কে এই শাহীন

চনপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা ও শাহীনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীনের জন্ম পুরান ঢাকায়। ঢাকার সিটি গলি থেকে আসায় চনপাড়ায় শাহীনের আলাদা পরিচয় দাঁড়ায় 'সিটি শাহীন' নামে। ৭ ভাই-বোনের মধ্যে শাহীন সবার ছোট। তার বাবা প্রয়াত মজিবুর রহমান ছিলেন একজন পরিবহন নেতা। তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন চনপাড়ায়। দ্বিতীয় বিয়ে করার পর তার প্রথম স্ত্রী ৪ বছরের শিশু শাহীনকে চনপাড়ায় বাবা মজিবুরের কাছেই রেখে যান। শাহীন বেড়ে ওঠেন এখানেই। চনপাড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত নব কিশলয় উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি।

শাহীনের স্ত্রী রোকেয়া আক্তার ইতির ভাষ্য, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর পক্ষে রাজনীতি করতেন শাহীন।

এই শাহীনের বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ছিল। একাধিক থানায় তার বিরুদ্ধে মাদক আইনে ৬টি পৃথক মামলা আছে। যদিও স্ত্রী ইতিসহ পরিবারের দাবি, শাহীন মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে তার কয়েকজন অনুসারী মাদক ব্যবসা করতেন কিংবা করেন।

শাহীন ও চনপাড়ার মাদক ব্যবসা নিয়ে কয়েকদিনে চনপাড়ার অন্তত ৩০ জন স্থানীয় বাসিন্দা এবং রাজনীতিকের সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের। তারা বলছেন, শাহীন নিজে কখনো সরাসরি মাদক বিক্রি করতেন না। তবে তিনি চনপাড়ার ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ৩টি মাদক বিক্রির স্পট নিয়ন্ত্রণ করতেন। এসব স্পটে শাহীনের লোকজন মাদক বিক্রি করত। তার ভাগ পেতেন শাহীন। আর চনপাড়ার মাদক নির্মূল কমিটির সদস্য সচিব পদেও ছিল শাহীনের নাম।

রাশেদুল ইসলাম শাহীন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে রাশেদুল ইসলাম শাহীনের টানানো একটি ব্যানার। এর উপরে ডান পাশে রয়েছে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক) ও তার ছেলে গোলাম মর্তুজা পাপ্পা গাজীর ছবি। একটু নিচে বামে রয়েছে সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে আটক কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান বজলুর রহমানের ছবি। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

গোলাম দস্তগীর গাজীর 'অনুসারী' ছিলেন শাহীন

পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি চনপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দারাও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে শাহীনের সংশ্লিষ্টতার কথা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর অনুসারী হিসেবে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের যেকোনো সমাবেশে চনপাড়া থেকে বড় মিছিল নিয়ে যেতেন শাহীন। সর্বশেষ গত ২৩ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ শহরের ইসদাইরে অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনেও চনপাড়া থেকে মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

স্থানীয়দের ভাষ্য, শাহীন এমনিতে কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন না। তবে আওয়ামী লীগের কোনো মিটিং-মিছিল থাকলে কাজ ফেলে রেখে হলেও তার সঙ্গে যেতে হতো। কেউ যেতে না চাইলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন তিনি। সভা-সমাবেশের দিন দোকানপাট খোলা থাকলেও তা ভাঙচুর করতো তার লোকজন।

স্থানীয় সূত্র ও পুলিশের দেওয়া তথ্য বলছে, ফারদিন হত্যাকাণ্ডের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির আগে মাদক ও সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য চনপাড়ায় সিটি শাহীন, জয়নাল আবেদীন ও রাজু আহম্মেদ ওরফে রাজার নামে ৩টি বাহিনী সক্রিয় ছিল। ৩ বাহিনীরই নিয়ন্ত্রক ছিলেন প্যানেল চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বজলুর রহমান। ১ বছর আগে জয়নালের সঙ্গে বজলুর দূরত্ব তৈরি হলে শাহীন ও রাজা তার আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। শাহীনকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের পদ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন বজলু।

গত বছরের মে মাসে একটি খুনের ঘটনা ঘটে চনপাড়ায়। ওই খুনের মামলায় আত্মসমর্পন করলে আদালত শাহীনকে কারাগারে পাঠান। তবে ইউপি নির্বাচনের কয়েকদিন আগে জামিনে ছাড়া পান তিনি। জেল থেকে বেরিয়ে নির্বাচনে বজলুর পক্ষে কাজ করেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ২ নেতার ভাষ্য, কয়েক বছর আগেও রাজনীতিতে সিটি শাহীনের নামডাক ছিল না। শাহীন, জয়নাল ও রাজা একসঙ্গেই বাহিনী চালাতেন। বজলু ছিলেন তাদের সবার নেতা। বজলুর মাধ্যমেই মন্ত্রী ও মন্ত্রীর ছেলের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পান শাহীন। গত ২-৩ বছরে সব রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে বজলুর নেতৃত্বে শাহীনই চনপাড়ার লোকজন নিয়ে যাওয়া শুরু করেন।

রাশেদুল ইসলাম শাহীন
সন্তান কোলে রাশেদুল ইসলাম শাহীনের স্ত্রী রোকেয়া আক্তার ইতি। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

'বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করা হয় শাহীনকে'

চনপাড়ার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে 'দেড় প্লট' জমির ওপর দোতলা পাকা ভবন শাহীনের। এই ভবনের নিচতলায় স্ত্রী ও ২ শিশুসন্তানকে নিয়ে থাকতেন তিনি। দোতলায় আরেকটি কক্ষ ও ছনের ঘর আছে। ছনের ঘরটি ছিল শাহীনের আড্ডার জায়গা।

শাহীনের স্ত্রী ইতির দাবি, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত শাহীন স্থানীয় নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের জেরে মারা গেছেন। তার অভিযোগ, বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে শাহীনকে 'বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেছে র‌্যাব'।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইতি ডেইলি স্টারকে জানান, আগের রাতে বাড়িতেই ছিল শাহীন। গভীর রাতে ঘুমাতে যান। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে বসার পরপরই একটা ফোন পেয়ে বেরিয়ে যান তিনি। বের হওয়ার সময় তার পরনে ছিল লুঙ্গি ও টি-শার্ট।'

ইতি বলেন, 'শাহীনরে আমি রাস্তা পর্যন্ত আগাইয়া দিয়া আইসা গোসলে যাই। গোসল শেষ কইরা বাইর হওয়ার পরই একটা ফোন আসে আমার কাছে। ফোনে জানতে পারি শাহীনরে র‌্যাব-১ ধরছে। আমি ভাবছি শুধু ধরছে, কিছু করে নাই। আমি দৌঁড়াইয়া যেইখানে ওরে ধরছে সেদিকে (তিন নম্বর ওয়ার্ডের বালুর মাঠ) গেছি। পরে গিয়া শুনি, শাহীনরে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করছে। প্রথমে পায়ে তারপর বুকে গুলি করছে। মনের মতো গুলি করছে, চাইর-পাঁচটা গুলি করছে। পরে মরা লাশের মতো হেচরাইতে-হেচরাইতে নিয়া গেছে। যেই রাস্তা দিয়া নিয়া গেছে সেইখানে রক্তও দেখছি।'

ইতির ভাষ্য, ওখান থেকেই তিনি জানতে পারেন শাহীনকে ডেমরার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরপর সেদিকেই যান তিনি। বলেন, 'আমুলিয়ার রাস্তা পর্যন্ত যাওয়ার পর একটা হাইয়েস গাড়িতে শাহীনরে উঠাইয়া ফেলতে দেখছি। আমি সেইখানে যাওয়ার পর আমার ওপর র‌্যাবের লোকজন হামলা করে। আমি তাগো পায়ে ধইরা বলছি, আমার স্বামীরে মাইরা ফেইলেন না, তারে ভিক্ষা দেন। ও যে মৃত তা আমি তখনও জানতাম না।'

এরপর দুপুর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত শাহীনের কোনো খবর পাননি বলে জানান ইতি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েও শাহীনের কোনো খোঁজ পাননি। পরে রাত ১১টার দিকে টেলিভিশনের খবরে শাহীনের 'ক্রসফায়ারের নিউজ' পান বলে জানান ইতি।

ফারদিন হত্যার ঘটনায় শাহীন 'কোনোভাবেই' জড়িত নন বলে দাবি করেন ইতি। তিনি বলেন, 'বুয়েটের যে ছেলেটা মারা গেছে তার সঙ্গে আমার স্বামীর কোনো সম্পর্ক নাই। আমি যাতে র‌্যাবের এই হত্যার বিচার চাইতে না পারি, সেইজন্য ঘটনা এইদিকে নিছে।'

ইতি আরও বলেন, 'ধরলাম আমার স্বামী ওই ছেলেরে (ফারদিন) খুন করছে। কিন্তু আমার স্বামীর মুখের জবানবন্দি তো নিবো। আমার স্বামীর বিচার আদালত করব, আইনে করবো, র‌্যাবে কেন হত্যা করব। আমার স্বামী খারাপ মানলাম, আইনে তার বিচার হইতো। র‌্যাব মারলো কেন? এইটা কেমন বিচার?'

স্থানীয়ভাবে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও শাহীনের মৃত্যুর পর তার কাছে গিয়েও কোনো 'সুবিচারের' আশ্বাস পাননি বলে দাবি করেন ইতি। শাহীনের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশ নেওয়ার ভিডিও ও ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, 'আমার স্বামীরে শুধু ব্যবহার করছে। কোনো পদ দেয় নাই। সে মন্ত্রী-মন্ত্রী করতে করতে মারা গেছে। সে কার দল করে সেটা সবাই দেখছে।'

শাহীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি যখন এলাকায় যাই তখন মিছিলের পেছনে তো অনেকেই থাকেন। সবাইকে তো আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কে কীভাবে ছবি বের করে পোস্টার করছে সেটা বলা কঠিন। সবাইকে তো ধরে ধরে নিষেধ করা যায় না।'

মন্ত্রীর ভাষ্য, তিনি কিংবা তার দল মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের কখনোই 'প্রশ্রয়' দেন না।

রাশেদুল ইসলাম শাহীন
বালু সেতু পার হয়ে এই একটিমাত্র সড়ক ধরে প্রবেশ করা যায় চনপাড়ায়। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

২৭ সেপ্টেম্বরের অভিযানেও 'র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছিলেন' শাহীন

ইতি জানান, গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে র‌্যাবের আরেকটি অভিযানে ধরা পড়ার পর কৌশলে পালিয়ে যান শাহীন। বলেন, 'ওই ঝামেলার পরই র‌্যাব হুমকি দিছিল, "এইবার বাঁইচা গেছোস, আরেকবার যদি আমাগো হাতে পরোস তাইলে তোর আর রেহাই নাই।"'

ওই অভিযানের পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে রূপগঞ্জ থানায় ৩টি মামলা করা হলেও তার একটিতেও শাহীনের নাম রাখা হয়নি বলে জানান ইতি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মামলায় নাম দেয় নাই তারে মাইরা ফেলবো দেইখা। র‌্যাবের ফর্মা শাহীনরে বলছিল, "তোর নামে কোনো মামলা করা হয় নাই, তোরে ডাইরেক্ট খুন করা হইবো"।'

মামলা করতে চান শাহীনের স্ত্রী

স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে শাহীনের স্ত্রী বলেন, 'আমার স্বামী যত বড় অপরাধী হোক, তারে মারার অধিকার তো তাদের (র‌্যাবের) নাই। তারা যত বড় আইনের লোকই হোক আমি তাদের বিচার চাই। র‌্যাব (শাহীনকে) কন্ট্রাক্ট কইরা গুলি কইরা মারছে। আমি মামলা করতে চাই, আমারে মামলা করার সুযোগ দেওয়া হোক।'

শাহীন মারা যাওয়ার পর তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ অনুসারীকেও র‌্যাব আটক করে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন ইতি। এদের মধ্যে কাজল, সাইজুদ্দিন ও বিল্লালের নাম বলেন তিনি।

এ বিষয়ে সাইজুদ্দিনের মা সাজু বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাইজুদ্দিন একটা সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। কাজ না থাকলে শাহীনের লগেই থাকতো। ওইদিনই সাইজুদ্দিন শাহীনের লগে আছিল। শাহীন গুলি খাওয়ার পর সে পলাইয়া যায়। ডরে সাইজুদ্দিন আর বাসায় আসে নাই। গত সোমবার রাইতে তারে শরীয়তপুর থেইকা ধইরা নেয় র‌্যাব। এখন পর্যন্ত (মঙ্গলবার বিকেল) কোনো খবর জানি না।'

রাশেদুল ইসলাম শাহীন
বালুর মাঠ। এখানেই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান শাহীন। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য: গুলি খেয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন শাহীন

চনপাড়ার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বালুর মাঠ বলে পরিচিত যে জায়গাটিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন শাহীন, সেখানে তাকে প্রায়ই আড্ডা দিতে দেখা যেত বলে জানান স্থানীয়রা। এখানকারই একটি স্পটে শাহীনের অনুসারীরা মাদক বিক্রি করতেন বলেও জানান তারা।

র‌্যাবের সঙ্গে কথিত 'বন্দুকযুদ্ধের' ওই ঘটনার ২ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা হয়েছে ডেইলি স্টারের। তাদের একজন মধ্যবয়সী নারী, অন্যজন কলেজশিক্ষার্থী।

মধ্যবয়সী ওই নারী জানান, ঘটনার সময় তিনি বালুর মাঠের পাশে একটি দোকানের সামনে ছিলেন। হঠাৎ মানুষের দৌড়াদৌড়ির মধ্যে ৩টি গুলির শব্দ শোনেন তিনি। একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় টেনে নিয়ে যেতে দেখেন।

ওই নারী বলেন, 'যারা গুলি করছে তারা যে র‌্যাব বুঝি নাই। নিয়া যাওয়ার পর লোকজন বলতেছিল, ওরা র‌্যাব।'

আর এলাকার এক কলেজশিক্ষার্থীর ভাষ্য, 'গুলি খাওয়ার পরও শাহীন দৌড় দেয়। পরে তারে দৌড়াইয়া র‌্যাবের লোকজন ধরে। এরপর তারে নিয়া রহমত শাহ্ ও হেকমত শাহ্ মাজারের পেছন দিয়া নদীর পাড়ের দিকে চইলা যায়।'

গত ১০ নভেম্বরের এই 'বন্দুকযুদ্ধের' বিষয়ে র‌্যাব-১ এর কমান্ডিং অফিসার আবদুল্লাহ আল মোমেন পরদিন দাবি করেন, সেদিন দুপুর ২টার দিকে চনপাড়ার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাছে র‌্যাবের একটি দল অভিযান চালালে শাহীন গুলিবিদ্ধ হন।

মোমেন বলেন, 'র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে শাহীন ও তার দল শটগান ও পিস্তল দিয়ে র‌্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তারা আমাদের ইটপাটকেলও ছুঁড়ে মারছিল। আত্মরক্ষার্থে র‌্যাব পাল্টা গুলি চালালে শাহীন লুটিয়ে পড়ে এবং তার সঙ্গীরা পালিয়ে যায়।'

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে এও জানান যে, 'বন্দুকযুদ্ধে' ৪-৫ জন র‌্যাব সদস্য আহত হয়েছেন।

অবশ্য পরদিন রূপগঞ্জ থানায় র‌্যাব-১ এর পরিদর্শক মো. আশরাফুজ্জামান বাদী হয়ে যে হত্যা মামলা দায়ের করেন তার এজাহারে বলা হয়, অজ্ঞাতনামা মাদক ব্যবসায়ীদের এলোপাথাড়ি গুলিতে শাহীন গুলিবিদ্ধ হন৷ তাকে উদ্ধার করে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে তিনি মারা যান।

 

Comments

The Daily Star  | English
Banking sector crisis

Why is the banking sector crisis so deep-rooted?

The regime-sponsored immorality to protect or pamper the financial gangsters not only eroded the future of the banking sector, but also made the wound too difficult to recover from.

5h ago