জঙ্গলে পরিণত শ্রীমঙ্গল বিসিক শিল্পনগরী

বিসিক শিল্প নগরী
যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিসিক পরিণত হয়েছে এক জঙ্গলে। ছবি: স্টার

বিশাল প্লট থাকলেও গত ৪ বছরে কোনো বরাদ্দ হয়নি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল বিসিক শিল্পনগরীর জন্য। ভবন থাকলেও এখনো কোনো কারখানা স্থাপন করা হয়নি।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) প্রচারণার অভাব, প্লটের মূল্য বৃদ্ধি, নিরাপত্তার অভাব ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ না হওয়ায় এ অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।

যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিসিক পরিণত হয়েছে এক জঙ্গলে।

স্থানীয় উদ্যোক্তারা বলছেন, বিসিকের প্লটে জমির দাম স্থানীয় দামের চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি। সরকার ভর্তুকি না দিলে এসব প্লটে শিল্প স্থাপন সম্ভব নয়।

স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা জানান, উদ্যোক্তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্লট বরাদ্দ পেতে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কিন্তু মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। প্লট প্রস্তুত, কিন্তু ক্রেতা নেই।

বিসিক কর্তৃপক্ষ জানায়, মৌলভীবাজারের বিনিয়োগকারীদের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলার উত্তরসুর এলাকায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পভিত্তিক মৌলিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয়েছে।

সেখানে বিসিক কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত একাধিক অফিস ভবন, পাম্প হাউস এবং পাম্প ড্রাইভার কোয়ার্টার, ডাম্পিং ইয়ার্ড, মসজিদ, পুকুর এবং অন্যান্য সুবিধা দিয়ে সুন্দরভাবে নির্মিত। এ ছাড়া এখানে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও আছে।

বিসিক কর্তৃপক্ষ জানায়, শ্রীমঙ্গলে ২০১২ সালের জুলাই মাসে ২০ একর জমির উপর শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠিত হয়। এর বাস্তবায়নের তারিখ ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন। এখানে ১২২টি প্লটের শিল্পনগরী গড়ে তুলতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

কিন্তু ২০১৯ সালে প্রাথমিকভাবে মাত্র ৩টি প্লট ৩ উদ্যোক্তার কাছে বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে ওই ৩ জন আবার টাকা ফেরত নেন। প্রতি শতক জমির দাম ছিল ৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।

বিসিক
নিরাপত্তারক্ষী জানিয়েছেন, বিসিকের ভেতরে ৩ বারে মোট ৫টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। ছবি: স্টার

স্থানীয় ব্যবসায়ী সামাদ মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রশাসনিকভাবে জনবল নিয়োগসহ যথাযথ প্রচারণার অভাবে আমার মতো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন না। এ ছাড়া জমির দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় ক্রেতারা প্লট কিনতে আগ্রহী নন।'

সরেজমিনে বিসিক এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায়, সেখানে একজন প্রহরী আছেন। বিসিকের দুটি মানসম্মত ভবন আছে। কিন্তু সেখানে একজন প্রহরী ছাড়া আর কেউ নেই।

যোগাযোগ বা মোবাইল নম্বরের জন্য কোনো সাইনবোর্ড বা ব্যানার নেই। বিসিকের সীমানার ভেতরে লতা-গুল্ম জন্মে জঙ্গলের মতো হয়ে আছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাঁচামালের প্রাপ্যতা থাকা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য ভারি শিল্প সেখানে গড়ে ওঠেনি। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের অবস্থাও নাজুক।

শ্রীমঙ্গল বিসিক ক্যাম্পাসের কেয়ারটেকার বিশ্বজিৎ সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে একাই থাকি। এখানে ৩ বারে ৫টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। এখন আমরাই অন্ধকারে থাকছি। প্রতিটি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে।'

শ্রীমঙ্গল বিসিকের এস্টেট অফিসার এ কে এম ফজলুল করিম ডেইলি স্টারকে জানান, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলো জানানো হয়েছে।

তিনি বলেন, 'সব প্লটই খালি। প্রথম ধাপে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আবেদন চাওয়া হলেও, মাত্র ৩ জন সাড়া দেন। পরে তারা তাদের প্লট বাতিল করে দেন।'

'এ শিল্পনগরীতে জমির দাম অনেক বেশি বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা,' বলেন তিনি।

ফজলুল করিম বলেন, 'প্লটের দাম আমাদের প্রধান কার্যালয় নির্ধারণ করেছে। এখানে আমাদের বলার কিছু নেই।'

প্রচারণার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'প্রধান কার্যালয় যেভাবে নির্দেশ দিয়েছে আমরা ঠিক সেভাবেই করছি।'

টি প্ল্যান্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সদস্য সচিব জহর তরফদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শ্রীমঙ্গল এখন ব্যবসার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। এখানে চা নিলাম কেন্দ্র আছে। শ্রীমঙ্গলে জমির চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু বিসিক তার জমির জন্য অনেক বেশি দাম চাচ্ছে। ফলে বিসিক থেকে উপকার পাচ্ছেন না নতুন উদ্যোক্তারা।'

'রাস্তার পাশের জমির বর্তমান মূল্য দেড় লাখ টাকা এবং সামান্য ভেতরে ১ লাখ টাকা। তবে বিসিকের জমির মূল্য ধরা হয়েছে ৪-৫ লাখ টাকা। এত দাম দিয়ে কে কিনবে,' বলেন তিনি।

এ কারণে উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিসিক
শ্রীমঙ্গল বিসিক নগরীতে প্লট প্রস্তুত, কিন্তু ক্রেতা নেই। ছবি: স্টার

এখানে জমি বরাদ্দ নিয়েছিল প্রঙ্গব অ্যাগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পুলক সূত্রধর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই শিল্পনগরীতে জমির দাম অনেক বেশি। তাই জমির দাম না কমালে সেখানে শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব নয়।'

'দাম বেশি হলেও বিসিকের প্লট নিয়েছিলাম। কিন্তু অধিকাংশ স্থানীয় বিনিয়োগকারী প্লট নিতে আগ্রহ দেখাননি। আমিও উপায় না পেয়ে টাকা ফেরত নিয়েছি,' বলেন তিনি।

তার মতে, এখানে প্লট তৈরি করতে অনেক খরচ হয়েছে বলে তারা এত দাম চাইছে।

তিনি বলেন, 'বিসিককে উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। নয়তো উদ্যোক্তারা কীভাবে এগিয়ে যাবে?'

'সব বিষয় বিবেচনা করে আমি প্লট প্রত্যাখ্যান করেছি। অন্যদিকে মৌলভীবাজার সড়কে কম দামে জায়গা কিনে কারখানা স্থাপন করেছি,' বলেন এই উদ্যোক্তা।

যোগাযোগ করা হলে মৌলভীবাজার বিসিকের উপব্যবস্থাপক মো. বেল্লাল হোসেন ভূঁইয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভূমি অধিগ্রহণের জন্য সরকারি বিধান অনুযায়ী ৩ গুণ বেশি দামে জমি কিনতে গিয়ে প্লটের দাম বেড়ে গেছে। কয়েকদিন আগে সচেতনতামূলক সভাও হয়েছে, সেখানে প্লটের দাম নিয়ে আলোচনা হয়েছে।'

'আমরা আমাদের প্রধান কার্যালয়ে বারবার জানিয়েছি। কিন্তু প্লট আমরা ৫ বছরের মধ্যে ১০ কিস্তিতে বিক্রি করতে পারি। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্যও একটি সুযোগ,' যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'একই প্রতিষ্ঠানের নামে ৪০টি প্লট বরাদ্দের অনুমোদনের জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি প্রক্রিয়াধীন আছে। তবে সীমানার ভেতরে কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি।"

শ্রীমঙ্গল বিসিক শিল্পনগরীর প্রসার প্রসঙ্গে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Shutdown is another economic peril

Vowing to continue an indefinite work stoppage and stage a protest march on tax offices, the NBR Reform Unity Council has intensified its demands

8h ago