নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকতে পারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব
চলতি বছরে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৮২ জন মারা গেছেন, যা এক বছরে সর্বোচ্চ। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৪ হাজার ৮০২ জন, যা এক বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বিশেষজ্ঞরা বছরের শুরুতেই বলেছিলেন, এ বছর দেশে ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। তাদের সেই অনুমানেই সত্য হয়েছে।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সঠিক সময়ে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ডেঙ্গুর তীব্রতা কমতে শুরু করবে বলে আশা করছেন তারা।
তবে, অন্যান্য বছর যে হারে রোগী কমেছিল, এ বছর সে হারে নাও কমতে পারে। জনসচেতনতাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগের তথ্য রেকর্ড করা হয় ২০০০ সালে। সেই বছর ডেঙ্গুতে ৯৩ জনের মৃত্যু হয় এবং ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। দেশে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে ২০১৯ সালে। ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয় এবং হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। গত বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১০৫ জন মারা যান এবং হাসপাতালে ভর্তি হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'মেয়র হানিফের পর ঢাকা নগরীতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কেউ তেমন কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেননি। এ বছর ডেঙ্গু প্রতিরোধে শুরুর দিকে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো কার্যকর ছিল না বলেই ডেঙ্গু এই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমরা রোগী ও মৃত্যুর যে তথ্য পাই, এর বাইরেও অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন। ঢাকার বাইরে এডিস অ্যালবোপিকটাস মশা ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। এই এডিস অ্যালবোপিকটাস মশা ঝোপ-ঝাড়, গাছপালার মধ্যে থাকে। কাজেই জনগণের সচেতন হওয়া ছাড়া এখন আর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না।'
এই কীটতত্ত্ববিদের পরামর্শ, 'এই মুহূর্তে সিটি করপোরেশনের করার কিছু নেই। একমাত্র জনসচেতনতাই পারবে মানুষকে ডেঙ্গু থেকে বাঁচাতে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে বাসায় সকাল-বিকেল অ্যারোসেল স্প্রে করতে হবে, শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষকে ফুলশার্ট, ফুলপ্যান্ট এবং হাতে ও পায়ে মোজা পরে থাকতে হবে। দিনে ঘুমালে অবশ্যই মশারির ভেতর ঘুমাতে হবে।'
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব বেড়েছে। চলতি বছরে মে মাসে ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়। আমরা শুরুতেই কার্যকরভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। এর ফলে জ্যামিতিক হারে মশা বেড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি।'
তিনি বলেন, 'বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, এডিস মশার ঘনত্ব এবং ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দেখে মনে হচ্ছে, শিগগির ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তবে আশা করছি, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে রোগী কমতে শুরু করবে। তবে তা অন্যান্য বছরের মতো কমবে না।'
ঢাকা শহরে সারা বছরই ডেঙ্গু বিদ্যমান থাকবে জানিয়ে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, 'সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ এডিস মশার জন্য আলাদাভাবে সারা বছর চালাতে হবে। এর সঙ্গে নগরবাসীদের নিশ্চিত করতে হবে, কোনোভাবেই যেন এডিস মশার প্রজনন বাড়িতে না হয়।'
কীটতত্ত্ববিদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ফ্যাকাল্টি ড. জিএম সাইফুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু এ বছর মানুষ ভিন্ন ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাই হার্ড ইমিউনিটি হওয়ার সম্ভাবনা কম। এডিস মশা কামড়ানোর সাধারণত ১০-১২ দিন পর জ্বর আসে। তবে আশা করছি আগামী ২ সপ্তাহ পর ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসবে।'
তিনি বলেন, 'কয়েকটি কারণে মূলত এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। প্রথমত, থেমে থেমে বৃষ্টিপাত; দ্বিতীয়ত, তাপমাত্রা যেভাবে কমার কথা এ বছর এখনো সেভাবে কমছে না; তৃতীয়ত, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং এডিস মশার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করছে। তবে সবচেয়ে বড় আরেকটি কারণ হলো, সিটি করপোরেশনের যে কাজগুলো করার কথা ছিল তারা সেগুলো করেনি বা করতে পারছে না। তাদের কাজের ফলাফল আসছে কি না, সেটা তদারকি করার কেউ নেই। তাছাড়া ডেঙ্গু এখন শুধু ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন একমাত্র সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগই পারে দেশ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে।'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ৭ দিনে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। আমরা আশা করছি আগামী সপ্তাহে ডেঙ্গুর প্রকোপ কেমে যাবে।'
Comments