মাস্ক যুগে টালমাটাল টুইটার, পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন যারা

ছবি: রয়টার্স

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেই ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে টুইটার-মাস্কের দীর্ঘ নাটকীয়তার অবসান ঘটেছে। ইতিহাসের অন্যতম বড় এই ব্যক্তিগত চুক্তিটি কার্যকরের পর সূচনা হয়েছে নতুন যুগের। কর্মী ছাঁটাই, নগদীকরণ, একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের মতো একের পর এক পদক্ষেপের মাধ্যমেই টুইটারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক। 

১৬ বছরের এই প্রযুক্তি পণ্যটি নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নে মাস্কের পরামর্শক ছিলেন কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। 

সিএনবিসির অক্টোবরের ৩১ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে, টুইটারের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর টেসলা নির্বাহী প্রধান মাস্ক টুইটারকর্মীদের সপ্তাহের মধ্যে জনপ্রিয় এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কটির সাবস্ক্রিপশন এবং ভেরিফিকেশন সিস্টেম পুনরায় ডিজাইন করতে বলেছেন। টেসলা থেকে ৫০ জনের বেশি বিশ্বস্ত সফটওয়্যার প্রকৌশলী ও কর্মীদের টুইটারে নিযুক্ত করেছেন। টুইটারের কর্মীরা মাস্কের বিরুদ্ধে দিনে ১২ ঘণ্টার শিফটে সপ্তাহে ৭ দিন কাজ করানোর অভিযোগ এনেছেন।

মাস্ক এর আগে টুইটারের সাড়ে ৭ হাজার কর্মীর ৭৫ শতাংশ ছাঁটাই করবেন বলে মন্তব্য করেছিল বলে জানিয়েছে সিএনবিসি। সিইও, সিএফওসহ বেশকিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বরখাস্তের মাধ্যমেই টুইটারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন মাস্ক। ১৬ বছরের এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে মাস্ক অধ্যয়ের সূচনালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত যেসব পরিবর্তন এসেছে তা নিয়েই আজকের আলোচনা।

কর্মী ছাঁটাই

মাস্ক শুরুতেই টুইটার থেকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিইও পরাগ আগারওয়ালসহ, সিএফও, একাধিক ডিরেক্টরস, ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করেন। যাদের বহাল রাখা হয়েছে; তাদের কাছে ছাঁটাইযোগ্য কর্মীদের একটা তালিকা চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে ব্লুমবার্গ। প্রোডাক্ট টিমের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদেরকে ৫০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাতে ব্লুমবার্গ জানায়, টেসলার প্রকৌশলী ও পরিচালক পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একটা দল ছাঁটাই তালিকা তদারকি করছেন। ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে টুইটার কোডের সঙ্গে জড়িতদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শুরুতে তিন-চতুর্থাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা বললেও পরে সেই মন্তব্য থেকে সরে আসেন বলে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়।

নেপথ্যের নায়কেরা

বিলিয়ন ডলারের এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখতে নেতৃত্বের দরকার। শীর্ষ কর্মকর্তাদের ছাঁটাই, নীতিমালা বদলসহ টুইটারকেন্দ্রীক সব পদক্ষেপেই বিশ্বস্ত বন্ধু, উপদেষ্টা ও সমর্থকদের পরামর্শ নিতে দেখা গেছে। যাদের সঙ্গে টুইটারের কৌশল, নীতিমালা নির্ধারণ নিয়ে নিয়মিত বৈঠক হয়েছে বলে জানায় ব্লুমবার্গ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, পুরনো বন্ধু ও পেপাল সহকর্মী ড্যাভিড স্যাকস, বিনিয়োগকারী জেসন ক্যালাক্যানিস, আন্দ্রেসেন হোরোভিটজ, জেমস ও অ্যান্ড্রু মাস্ক। 

এই দলের মধ্যে আরও আছেন টুইটারের সাবেক এক নির্বাহী শ্রীরাম কৃষ্ণাণ, পরাগ আগারওয়াল কর্তৃক বরখাস্ত হওয়া সাবেক প্রোডাক্ট প্রধান কায়ভন বেকপুর। টুইটার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডর্সিও এই পরামর্শক দলের একজন ছিলেন; যার সঙ্গে মাস্কের সম্পর্কও দারুণ। শ্রীরাম ও ক্যালাক্যানিসের নিজস্ব টুইটার ইমেইল আছে। তবে, তাদের পদমর্যাদা বা নিয়োগ নিয়ে এখনো নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। 

এদিকে, টুইটার-মাস্ক আইনি লড়াই চলাকালে ইলন মাস্কের পুরাতন প্রাইভেট বার্তাগুলো ফাঁস হয় বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ। এই বার্তাগুলোর মধ্যে পরবর্তী সিইও কে হবেন তা নিয়েও আলোচনা চলেছে। যেখানে বেঞ্চমার্ক ক্যাপিটালের বিল গার্লে, উবার টেকনোলোজিস ইনকরপোরেশনের সাবেক সিইও এমিল মাইকেল ও জেসন ক্যালাকানিসের নাম উঠে এসেছে।

ছবি: রয়টার্স

ব্লুমবার্গে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, টেসলা প্রকৌশলীদের টুইটারের কোড রিভিউ করাসহ বেশ কিছু কাজের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।  টুইটারকর্মীদের বরাত দিয়ে সিএনবিসি জানিয়েছে মাস্ক প্লাটফর্মটিকে ঢেলে সাজাতে চাচ্ছেন। আর এ কারণে তার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন টেসলা, স্পেস-এক্স, নিউরোলিংক থেকে একাধিক উচ্চপদস্থ ব্যবস্থাপক, পরিচালক, প্রকৌশলীদের এনে টুইটারের সোর্স কোড, কন্টেন্ট মডারেশন ও ডাটা প্রাইভেসি সম্পর্কে যতদ্রুত সম্ভব সবকিছু জানতে বলেছেন।

এ ছাড়া টুইটার নিয়ে মাস্কের অন্যান্য পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- 
 
কন্টেন্ট মডারেশন

টুইটার নিয়ে মাস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রস্তাব ছিল প্লাটফর্মটিকে বাক-স্বাধীনতার স্বর্গে পরিণত করা। নিজেকে বাক স্বাধীনতার অবাধ সমর্থক দাবি করা মাস্ক প্লাটফর্মটির কন্টেন্ট তদারকি নীতির ঘোর বিরোধিতা করেছিল। রাজনৈতিক মেরুকরণ, মতামতে প্রভাব, হেট স্পিচ তথা ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, উগ্রতা ছড়ানো নিয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ আছে। 

টুইটার একাধিক নীতিমালার মাধ্যমে তাদের প্লাটফর্মের একাউন্ট ও কন্টেন্টগুলোর তদারকি শুরু করেছিল। মাস্ক অধ্যয়ের শুরুতেই এসব নীতিমালা ও কোডিংগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। অতীতে তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পসহ টুইটারে নিষিদ্ধ ও বাতিল একাউন্টগুলো আবারও চালু করার কথা বলেছেন। 


  
সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটটিতে মাস্কের ইতিহাসও খুব বিতর্কিত। সিএনএনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১০ কোটির বেশি অনুসারী থাকা মাস্কের করা অনেক টুইট নিয়েই তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদ, নারী-বিদ্বেষ, করোনা মহামারি নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো, সমকামীদের সমালোচনাসহ নানাবিধ বিতর্ক রয়েছে। 

তার প্রোফাইল থেকে কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে অ্যাডলফ হিটলারের ছবি তুলনা করে আপলোড করা হয়েছিল, যা পরে মুছে ফেলা হয়। এমন বিতর্কিত রেকর্ডের অধিকারী মাস্কের পরিচালনায় টুইটারের কন্টেন্টে আমূল পরিবর্তন আসা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা।

ভাইন

২০১২ সালে বিনোদন নেটওয়ার্ক ভাইন কিনেছিল টুইটার। যা পুরনো কোডিংয়ের ওপর নির্মিত হওয়ায় ২০১৬ সালেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্লুমবার্গের কাছে মাস্ক শাসনামলে এই পণ্যটিকে পুনরুজ্জীবিত করার ইঙ্গিত দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা। এটা এমন এক প্রযুক্তি যা সোশ্যাল সাইটগুলোটে ছোট আকারের ভিডিওর প্রচলন করেছে। বর্তমানে টিকটক, ইনস্টাগ্রামের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এই ট্রেন্ডের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

বর্তমানের অনেক কর্মী নিজেদের চাকরি বাঁচাতে ভাইন প্রজেক্টের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। পুরাতন কোডিং রিরাইট করে নতুন উদ্যমে শুরু করা হতে পারে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। যদিও এই কাজটা খুব একটা সহজ নয় বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভেরিফিকেশন

টুইটার নিয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন হচ্ছে নগদীকরণ। বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে মাস্ক সাবস্ক্রিপশন মডেলের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ ও জনপ্রিয় ব্যবহারকারীদের বিনামূল্যে নীল ব্যাজ দিয়ে ভেরিফাই করা পদ্ধতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভেরিফিকেশন সেবাকে 'টুইটার ব্লু' নামের সেবা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে মাস্ক। 

সিএনএন সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে সেবাটির জন্য মাসিক ১৯ দশমিক ৯৯ ডলার ফি ধার্য করেছিল মাস্ক। কিন্তু, এই ফি নিয়ে চরম বিতর্ক শুরু হয়, একাধিক ব্যক্তি নিন্দা জানিয়ে টুইট করে। যাদের মধ্যে বিখ্যাত লেখক স্টিফেন কিং অন্যতম। এই নীতির নিন্দা জানিয়ে তিনি টুইটে লেখেন, নীল ব্যাজ রাখতে আমাকে প্রতি মাসে ২০ ডলার দিতে হবে? তাদের উচিত আমাকে টাকা দেওয়া।' এরপরেই মাস্ক মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি কমিয়ে ৮ ডলার করার কথা বলেন।

টেসলায় নিজের শেয়ার বিক্রি, ঋণ ও বিনিয়োগ নিয়ে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে টুইটার কিনতে হয়েছে মাস্ককে। যে টাকা তুলতে তিনি টুইটারকে নগদীকরণের সব চেষ্টাই করতে পারেন। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট নিয়ে অভিজ্ঞ না হলেও একজন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী হিসেবে মাস্ক একজন সফল ব্যক্তি। যিনি এত বিপুল পরিমাণের প্রতিষ্ঠানকে মুনাফা আনতে সব চেষ্টাই করবেন।

তথ্যসূত্র: সিএনএন, ব্লুমবার্গ, ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনবিসি 

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

7h ago