শৈশব রাঙানো তালের আঁটির শাঁস

ঘর থেকে বের হলেই ছোট্ট নালা, তার পাশেই ছিল মুরগির খোঁয়াড়। খোঁয়াড়ের নিচের মাটি আংশিক স্যাঁতস্যাঁতে ও দুর্গন্ধময়। সেখানে কদাচিৎ যাওয়া হয়। আর যাওয়া হবেই বা কেন? জায়গাটা ইঁদুর, আরশোলা, বিষ পিঁপড়া কিংবা পরিত্যক্ত আসবাবপত্রের দখলেই থাকে। মাকড়সার জাল ছড়িয়ে থাকে চারপাশে। কিন্তু কার্তিকের হিম যখন এসে ভিড়ত আমাদের উঠান-ঘরের দুয়ারে, তখন আর তর সইতো না আমাদের।
তালের আঁটির শাঁস। ছবি: সংগৃহীত

ঘর থেকে বের হলেই ছোট্ট নালা, তার পাশেই ছিল মুরগির খোঁয়াড়। খোঁয়াড়ের নিচের মাটি আংশিক স্যাঁতস্যাঁতে ও দুর্গন্ধময়। সেখানে কদাচিৎ যাওয়া হয়। আর যাওয়া হবেই বা কেন? জায়গাটা ইঁদুর, আরশোলা, বিষ পিঁপড়া কিংবা পরিত্যক্ত আসবাবপত্রের দখলেই থাকে। মাকড়সার জাল ছড়িয়ে থাকে চারপাশে। কিন্তু কার্তিকের হিম যখন এসে ভিড়ত আমাদের উঠান-ঘরের দুয়ারে, তখন আর তর সইতো না আমাদের।

সাতসকালে সোল্লাসে আমরা যখন সেখানে ছুটতাম তখন আমাদের চোখেমুখে সে কী তীব্র উত্তেজনার পারদ! আড়ালে থাকা চ্যালাকাঠ, ঝুরঝুরে মাটি সরাতেই বিষ পিঁপড়ার বান ডাকত যেন। ছুট লাগাত ভীত ধেড়ে ইঁদুর। কিন্তু তাতেও আমাদের আগ্রহের বিন্দুমাত্র কমতি নেই। স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় তখন মাসখানেক পর বোধহয় প্রথমবারের মতো সূর্যের আলোর কণার অনুপ্রবেশ ঘটত।

আমাদের আগ্রহ তখন তুঙ্গে। এখানেই তো মা-দাদীরা মাস খানেক আগে ফেলেছিলেন পাকা তালের ছিবড়ে নিংড়ানো আঁটি। সেখানে এখন গজিয়েছে শেকড়। মাটিতে জেঁকে বসেছে কিছুটা। সেই শেকড় ছিঁড়ে তালের আঁটি আমরা উঠাতাম। এরপর পড়িমরি করে সেই সদ্য অঙ্কুরিত হওয়া তালের আঁটি নিয়ে ছুট লাগাতাম উঠানে। উঠানে রেখেই আবার ছুটতাম এক পাশে আড়ালে ঘুমানো খেজুরের রস জ্বাল দেওয়ার চুলায়। সেই চুলা কেবল পৌষ-মাঘেই ব্যবহৃত হতো।

শক্ত তালের আঁটি কাটলেই দেখা মেলে সুস্বাদু নরম শাঁসের। ছবি: সংগৃহীত

ভাঙা বেড়া, নারকেলের শুকনো পাতার আচ্ছাদন দেওয়া সেই চুলার তলা শুকনো ছাই ভর্তি। ছাই সরাতেই দেখা মিলত অঙ্কুরিত ছাই রঙের তালের আঁটির। এখানে অবশ্য তেমন শেকড় জন্মাত না। আঁটি তুলে আমরা আবার ছুট দিতাম। সঙ্গে চ্যালাকাঠ। এরপর যাত্রা পুকুর পাড়ে।

অঙ্কুরিত তালের আঁটিগুলো সেখানে ধোয়া হতো ঘষেমেজে। পুরো সাফ-সুতরো করে আবার যাত্রা উঠানে। চ্যালাকাঠের ওপরেই রাখা হতো আঁটি। এরপর দা কিংবা কুড়াল দিয়ে জোরে এক কোপ। সঙ্গে সঙ্গে ওপরের শক্ত আবরণ বিভক্ত হয়ে ২ পাশে বেরিয়ে আসত শুভ্র তুলতুলে সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত শাঁস।

বলছিলাম তালের আঁটির শাঁসের কথাই। আঞ্চলিক ভাষায় আমরা বলতাম 'তালের ফোপরা'। বিভিন্ন অঞ্চলে তাল আঁটির শাঁস পরিচিত তাল খাজা, আঁকুর, গজাড়, তালকুটসহ নানা নামে। আমাদের শৈশব-কৈশোরের পুরোটা সময় জুড়ে যে অন্যতম জিনিসটি জড়িয়ে আছে, সেটি এই তালের আঁটির শাঁস।

ভাদ্র মাসে পাকা তালের রস চিপে হলদে রঙা তালের আঁটিগুলো আমরা ছাইমাটি কিংবা পরিত্যাক্ত জায়গায় ফেলে রাখতাম। ২ মাস বাদেই সেই তালের আঁটি অঙ্কুরিত হতো। শেকড় গজালেই ভেতরে শাঁসের জন্ম হতো। আমরা কী ভীষণ আবেগে প্রতীক্ষার প্রহর গুণতাম! প্রায়ই ছাই কিংবা মাটি সরিয়ে দেখতাম, তালের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে কি না।

অঙ্কুরিত তালের আঁটি। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে গ্রামেগঞ্জে তালের আঁটির শাঁস খাওয়ার চল আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। এর একটা বড় কারণ হলো আশঙ্কাজনকভাবে তালগাছের সংখ্যা কমে যাওয়া। এক সময় গ্রামে রাস্তাঘাটে, পুকুরপাড়ে, জঙ্গলের মাঝে, খেতের আইল থেকে বাড়ির সীমানায় তালগাছের আধিক্য চোখে পড়ত। তালের প্রাচুর্য ছিল বলেই পাওয়া যেত তালের আঁটি।

তালের আঁটির শাঁসের কিছুটা মিল পাওয়া যায় নারকেলের শাঁসের সঙ্গে। তবে নারকেলের আঁটির শাঁসের উপরিভাগ শুকনো থাকলেও তালের আঁটির শাঁস অপেক্ষাকৃত নরম।

ধর্মীয়ভাবেও আলাদা গুরুত্ব আছে তালের আঁটির শাঁসের। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজায় প্রসাদ হিসেবে ব্যবহার করেন তালের আঁটির শাঁস। বিশেষ করে লক্ষ্মী পূজায় তালের আঁটির শাঁস কেটে অন্য ফলের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

গ্রামাঞ্চলে তাল আঁটির শাঁস অঞ্চল ভেদে পরিচিত তাল ফোপরা, তাল খাজা, আঁকুর, গজাড়, তালকুটসহ নানা নামে। ছবি: সংগৃহীত

এ ছাড়া, তালের আঁটির শাঁস বাংলার উৎসব-পার্বণেও গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ ছিল। আশ্বিন সংক্রান্তির সাধভক্ষণ বা ধানকে সাধ খাওয়ানো অংশেও এটি খাওয়া হয়। গাসি উৎসবেও তালের আটির শাঁস দিয়ে শুরু হয় খাওয়ার পালা। এরপর খাওয়া হয় পিঠাপুলি কিংবা বিভিন্ন ভাজা।

বর্তমানে তালের আঁটির শাঁসকে দুর্লভই বলা চলে। জীবনাচার পরিবর্তিত হওয়ার পাশাপাশি পরিবর্তন এসেছে খাদ্যাভ্যাসে। সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে তালের আঁটির শাঁস খাওয়ার চলও। কিন্তু বাঙালির শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে এই অনন্য উপাদান।

Comments

The Daily Star  | English

Wage growth still below inflation

Unskilled workers wage grew 8.01% in September this year when inflation was 9.92%

4h ago