সুমনে দেখা হলো সকলের

১৩ বছর পর ঢাকার মঞ্চে গাইলেন সুমন। ছবি: স্টার

বয়স ৭০ পেরিয়েছে। অশক্ত শরীর গিটার ধরতেও বাগড়া দিচ্ছে ইদানিং। কিন্তু আগের সেই দৃপ্ত কণ্ঠ রয়ে গেছে গানওলার। ওই কণ্ঠেই উচ্চারিত গানের প্রতিটি কলি, বলিষ্ঠ উচ্চারণ আর সুরের প্রতিটি ভাঁজ বলে দিলো- প্রতিবাদে, প্রেমে, বিপ্লবে আজও তিনিই সুমন।

৩০ বছর আগে 'তোমাকে চাই' অ্যালবামের মধ্য দিয়েই বাংলা গানের জগতে সূচনা হয়েছিল নতুন ধারার। সেই ধারার পুরোধা কবীর সুমন ১৩ বছর পর শরতের শেষবেলায় এবার ঢাকায় এসেছেন 'অতিথি গাঙচিল' হয়ে। ফলে বাংলাদেশে তার অগুনতি ভক্তের মধ্যে ছিল তুমুল আগ্রহ।

কথা ছিল ১৫ অক্টোবর জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে আধুনিক বাংলা গান গাইবেন সুমন। ১৮ অক্টোবর বাংলা খেয়াল পরিবেশনার পর ২১ অক্টোবর আবার আধুনিক বাংলা গান দিয়ে আয়োজন শেষ হবে। ৩ দিনের অনুষ্ঠানের প্রায় সব টিকিটও বিক্রি হয়ে গিয়েছিল অল্প সময়েই। আয়োজক প্রতিষ্ঠান পিপহোলও জানিয়েছিল তাদের সব প্রস্তুতি শেষ।

কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঢাকা মহানগর পুলিশ সায় না দেওয়ায় জাদুঘরে এই গানের অনুষ্ঠান নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। শঙ্কা তৈরি হয় সুমনের আপামর ভক্ত-শ্রোতাদের মাঝে। পিপহোলের কর্মকর্তারা তখন ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে নতুন করে সব আয়োজন করতে বাধ্য হন।

পুরো অনুষ্ঠানজুড়েই সুমন ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল ও আমুদে ভঙ্গিতে। ছবি: স্টার

আজ শনিবার বিকেলে সব অনিশ্চয়তা শঙ্কা দূর করে কবীর সুমন আবার উঠলেন বাংলাদেশের মঞ্চে। গানে-কথায় জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশের প্রতি তার তীব্র অনুরাগের কথা। সেইসঙ্গে মিলনায়তনভর্তি আপ্লুত ভক্তকূলও তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে জানালেন সংহতি।

১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে ওড়িশায় খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও সমাজসেবী গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনস ও তার ২ শিশুপুত্রকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে বজরং দল। এই ঘটনার প্রতিবাদে সুমন চট্টোপাধ্যায় তার ধর্ম পরিবর্তন করে চলে আসেন 'সংখ্যালঘুর দলে'। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজেকে অভিহিত করেন কবীর সুমন হিসেবে।

এর কিছুদিন পর এক লক্ষ্মী পুজোর সকালে কলকাতায় সুমনের একক গানের একটি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সেটাই কবীর সুমন হিসেবে তার মঞ্চে প্রথম আবির্ভাব। সেদিন সকালের অনুষ্ঠানের জন্য সুমনকে নিয়ে একটি কবিতা লেখেন এখনকার বাংলা কবিতার অন্যতম পুরোধা জয় গোস্বামী।

ওই কবিতায় কবি জয় গোস্বামী কবিয়াল সুমনের উদ্দেশে বলেন, 'সুরের দেশভাগ হয় না/যখনই সুরে যাবে এ পাখি,/আমরা দল বেঁধে শুনব/কবীর সুমনের একাকী।/আগুন ছেলেমেয়ে আমাদের/আকাশ আমাদের দখলে,/যে যার বঁধুয়াকে ডেকে নাও/সুমনে দেখা করো সকলে।'

শনিবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে মূল আয়োজন শুরু হওয়ার কথা ছিল বিকেল সাড়ে ৪টায়। কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই সেখানে জড়ো হতে শুরু করেন সব বয়সী দর্শক-শ্রোতারা। সুমনকে নিয়ে, সুমনের গান নিয়ে তাদের মধ্যে যে আগ্রহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছিল তখন, তাতে সত্যিই মনে হতে থাকে যে, সুরের দেশভাগ হয় না। পাশাপাশি এটাও মনে হয়- সবাই যেন জয় গোস্বামীর আহ্বানে সাড়া দিয়েই মিলতে এসেছেন সুমনের সঙ্গে।

মঞ্চে সুমন ও তার সহশিল্পীরা। ছবি: স্টার

বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেন, রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী সময়ে কবীর সুমন আধুনিক বাংলা গানে সবচেয়ে বড় ঘটনা। সুমন যতটা পশ্চিমবঙ্গের, তার চেয়েও বেশি বাংলাদেশের। তার গানে বাংলাদেশ যেভাবে মূর্ত হয়েছে, কোনও বাংলাদেশির গানেও তা হয়তো হয়নি।

কবীর সুমন শেষবার ঢাকায় এসেছিলেন ২০০৯ সালের অক্টোবরে। তখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গান পরিবেশনে বাধা পেয়ে কলকাতায় ফিরেছিলেন।

মাঝে এক যুগ কেটে গেলেও আর ঢাকায় আসেননি তিনি। এক সাক্ষাৎকারে অভিমানের সুরে বলেছিলেন, বাংলাদেশে আর কখনও তিনি আসবেন না।

এর আগে নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসে গান করেছিলেন কবীর সুমন। সেবার তিনি টিকিট বিক্রির পুরো অর্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিলে দিয়েছিলেন।

সাদা ধুতি আর কুর্তা পরে আজ শনিবার বিকেল সোয়া ৫টায় সুমন যখন একাকী মঞ্চে উঠলেন তখন শ্রোতা-দর্শকদের সবাই তাকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান। সুমনও বৈঠকী ঢঙে স্বভাবসুলভ রসিকতা আর সুরের মায়াজালে আটকে ফেলেন সবাইকে। গেয়ে ওঠেন, 'একেকটা দিন দারুণ রঙিন/প্রেমিকার ঠোঁট আর নিশানের লাল/ একেকটা দিন বড়ো বেরঙিন/অসুখের মতো আসে আমার সকাল।'

গান চলতে থাকে। উঠে আসে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, সুফিয়া কামাল, শহীদ কাদরীসহ আরও অনেকে। একইসঙ্গে দ্রোহী-আবেগী সুমন কী-বোর্ডে কাঁপা কাঁপা হাত রেখে জোরালো কণ্ঠে বলে ওঠেন, 'একুশের হাত ধ'রে চেতনায় হয় হাতেখড়ি/বাংলা দেখলে আমি এখনও বাংলাদেশ পড়ি,/মুক্তিযুদ্ধ ডাকে আগামীর দিকে হেঁটে চলো/এ যদি আমার দেশ না হয় তো কার দেশ বলো?'

অনুষ্ঠান শুরুর আগে অপেক্ষারত দর্শক। ছবি: স্টার

এর আগে 'তোমাকে চাই' প্রকাশের ২০ বছরের পূর্তি উপলক্ষে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য সুমনকে অভিহিত করেছিলেন 'পিপলস আর্টিস্ট' হিসেবে। সেখানে তিনি সুমনের গান নিয়ে বলেন, 'রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন করলেন এবং গান লিখলেন। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক পরে দেশটা স্বাধীন হল ও নতুন একটা দেশ হল। এবার এপার বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে ওপার বাংলার ভাষা আন্দোলনের গর্জে ওঠার ছায়াপাত খুব একটা দেখা গেল না। বরং মাঝেমধ্যেই সুমনের গান আমাদের অপরাধ কিছুটা কমাল।'

কথায় কথায় সুমন বাংলাদেশের প্রতি তার অনুরাগ-ভালোবাসার কথা বোঝালেন আবারও। এবার সুফিয়া কামালকে নিয়ে লেখা গানের চরণ উদ্ধৃত করে বললেন, 'বোকারাই গান লেখে, গান বাঁধে, গান গেয়ে মরে/এবার মরলে আমি জন্মাবো আপনার ঘরে।'

আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সখেদে বলে ওঠেন, 'আমি কি এমন ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি যে, আমি বাংলাদেশের মাটিতে মরব!'

প্রথমদিনের গোটা আয়োজন শেষে আবার যেটা বোঝা গেল তা হলো- ইতিহাসের অন্ধকারতম পর্বেও মানুষ আলো দেখতে চায়। সেই আলো ক্রমে আসে। কবি না-বলতে পারা কথাগুলো বলেন। না করতে পারা কাজগুলো করেন বিপ্লবী মানুষেরা। আর না-গাইতে দেওয়া গান গেয়ে মানুষকে জাগান নাগরিক কবিয়াল।

মিলনায়তনের ভেতরে ঢোকার অপেক্ষা। ছবি: স্টার

পিট সিগার, পল রোবসনরা গান গেয়ে এমন আলো জ্বালিয়েছিলেন। তার আভা ছড়িয়ে পড়েছিল সারাবিশ্বে। সুমন আসলে এদেরই উত্তরাধিকার।

আবার নাট্যকার চন্দন সেনের মতে, 'সংগীত-সময়-কবিতা; এই তিন বিন্দুকে একত্রে এনে বাংলা গানের যে ভাণ্ডার লালন থেকে রবি ঠাকুর হয়ে বহমান, সুমন তার আজকের কাণ্ডারী।'

এগুলো বাদে ঢাকার মঞ্চে কবীর সুমনের এবারকার পরিবেশনার ভিন্ন যে দিকটি পরিলক্ষিত হয়েছে তা হলো- সুমন এবার মঞ্চে একা ছিলেন না। অথচ একক পরিবেশনা সুমনের গায়কীর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এর কারণ হিসেবে নিজের দুরারোগ্য স্নায়ুর অসুখের কথা জানান গানওলা, যে কারণে গিটার ধরা, এমনকি ঠিকমতো হাঁটতে-চলতেও পারছেন না তিনি।

তাই এই দফায় তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন সহশিল্পী ইন্দ্রজিৎ প্রধান। গিটারে ছিলেন ধ্রুব বসু রায়। পারকাশন বাজান বিশ্বজিৎ রায়।

Comments

The Daily Star  | English

Work begins to restore Dhaka’s waterways

Criticism on social media as advisers inaugurate work by walking down a red-carpeted pathway

6m ago