আর কবে শিখবে ইউরোপ
বলকান যুদ্ধের ভয়াবহতার ৩০ বছর পর ইউরোপের মাটিতে সংঘাত মোকাবিলায় পশ্চিম ইউরোপের অক্ষমতা যেন আবারও প্রকাশ পেয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রমাণ করছে সেই পরিস্থিতির আসলে কতটা পরিবর্তন হয়েছে।
১৯৯১ সালে যুগোস্লোাভিয়া যখন বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে, তখন লুক্সেমবার্গের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক পুস আশাবাদী মন্তব্য করেছিলেন, 'এটি ইউরোপের সময়, আমেরিকানদের নয়'।
তারপর থেকে অনেক সময় পেরিয়েছে। কিন্তু, ইউরোপ কেন একটি সামরিক শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে- তা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে অনুসন্ধান চলছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'আমেরিকা ফার্স্ট' মন্ত্রের সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল উভয়েই বলেছিলেন, ইইউ আর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে পারছে না।
চলতি বছরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউরোপের সবচেয়ে বড় দেশটির বিরুদ্ধে আগ্রাসন শুরু করেছে। ফ্রান্স ও জার্মানি ইউক্রেনের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ৭ মাস ধরে ওয়াশিংটনের ওপর সামরিকভাবে নির্ভর করে আসছে ও ব্রিটেনের উপর কিছুটা হলেও নির্ভর করছে।
কিয়েল ইন্সটিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড ইকোনমির মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ২৫ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং যুক্তরাজ্য ৪ বিলিয়ন ইউরোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিপরীতে জার্মানি ১.২ বিলিয়ন ইউরোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যখন কিয়েভের জন্য ফ্রান্সের সামরিক সমর্থন মাত্র ২৩৩ মিলিয়ন ইউরো নিবন্ধিত হয়েছে। ব্রিটেন ৫ হাজার ইউক্রেনীয় সেনাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং ফ্রান্স ১০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
এই অসঙ্গতিগুলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন! ইউরোপীয় ইউনিয়নের বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদন ১৪ ট্রিলিয়ন ইউরো এবং সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বাজেট ২৩০ বিলিয়ন ইউরো। ফ্রান্স অবশ্য জোর দিয়ে বলেছে, তারা যুদ্ধে 'সহযোগী' হতে চায় না। অন্যদিকে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ এই সংঘাতে জড়ানোকে ঝুঁকির আশঙ্কা বলে মনে করছেন।
এখন সবার নজর তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে কিনা এবং ইউরোপের অর্থনৈতিক কিংপিন জার্মানি ও ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নের একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত শক্তি লেপার্ড-২ ও লেক্লার্ক ট্যাংক পাঠাতে সম্মত হবে কিনা। ইউক্রেন নিজেই এখন আরও অস্ত্রের জন্য একটি আবেদন করছে। কারণ পুতিন এই যুদ্ধে আরও হাজার হাজার সেতা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপীয়দের মধ্যে ব্যয়ের পার্থক্য ইইউ নেতাদের সামনে প্রশ্ন তোলে যে, যদি তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতেন তাহলে কিয়েভের পরিস্থিতি কি এমন হতো?
গত মাসে এক বক্তৃতায় জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী ল্যামব্রেখট স্বীকার করেন, পরিস্থিতি অস্থিতিশীল।
ল্যামব্রেখট বলেন, জার্মানি এবং ইউরোপীয়রা শান্তি-শৃঙ্খলার ওপর নির্ভর করে, কিন্তু তারা নিজেরাই তার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। এর একটি কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্র ক্রমবর্ধমানভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দিকে 'তার মনোযোগ' ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ওয়াশিংটন হয়তো আর অতীতের মতো ইউরোপের প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। উপসংহারটি পরিষ্কার- আমরা ইউরোপীয়রা এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে জার্মানরা নিজেদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতা অর্জনে আরও বেশি কিছু করতে হবে। যেন অন্যান্য শক্তিগুলো আক্রমণ করার কথা চিন্তাও না করে।
তবুও এই শব্দগুলো কোনো উদ্যোগ অনুসরণ করে বলা হয়েছে কিনা তা অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তার সমালোচকরা অবশ্য পরে বলেন, প্রাক্তন চ্যান্সেলর মর্কেল ২০১৭ সালে একই কথা বলেছিলেন। মিউনিখে একটি পার্টিতে তিনি বলেছিলেন, আমরা ইউরোপীয়রা আমাদের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নিতে হবে। অবশ্য পরে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।
জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের ক্লডিয়া মেজর বলেন, এটি এমন একটি ঘটনা যা দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষাকে জর্জরিত করেছে। ইতোমধ্যে আমাদের সামনে আবার ১৯৯০-এর দশকে ফিরে এসেছে। আমরা সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করব এটি হতে পারে না।
তিনি ১৯৯৮ সালের ফ্রাঙ্কো-ব্রিটিশ সেন্ট মালো ঘোষণার কথা উল্লেখ করেছিলেন, যা বলকান যুদ্ধের ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া ছিল। যেখানে জোর দেওয়া হয়েছিল যে, ইউরোপের অবশ্যই 'বিশ্বাসযোগ্য সামরিক বাহিনী দ্বারা সমর্থিত স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থা থাকতে হবে'।
তিনি বলেন, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। কারণ, প্রধান ইউরোপীয় শক্তিগুলো 'সামরিকভাবে হুমকি বোধ করে না এবং কেবল যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে'।
ব্রাসেলস ইউরোপীয় দেশগুলোকে তাদের প্রতিরক্ষা প্রকল্পে যোগ দিতে নানাভাবে চেষ্টা করছে, কিন্তু অগ্রগতি খুবই কম।
গত মে'তে ইউরোপীয় কমিশন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সামরিক ব্যয় সমন্বয়ের জন্য একটি নতুন পরিকল্পনা প্রস্তাব করে। দেশগুলো প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনবে নাকি ইউরোপীয় কোনো দেশ থেকে কিনবে তা আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক জোসেপ বোরেল জোর দিয়ে বলেন, ইউরোপ তার প্রয়োজনের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্লক থেকে কিনে নেয় এবং আরও অভ্যন্তরীণ উৎসে স্থানান্তরের আহ্বান জানায়।
এই প্রস্তাবটি এখন কাউন্সিলের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা মূল্যায়ন করা হচ্ছে এবং আশা করা হচ্ছে, এটি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে যাওয়ার আগে নভেম্বরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের ডেস্কে পাঠানো হতে পারে। যাইহোক, ডসিয়ারে কাজ করা কূটনীতিকরা বিশ্বাস করেন না, এ ধরনের একটি সময়রেখা সম্ভব। কারণ আলোচনাটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণও খুবই কম। কমিশন দুই বছরের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব করছে, যাতে তারা যৌথ অস্ত্র সংগ্রহে সহায়তা করতে পারে, যা ইউরোডের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খুবই সামান্য।
কূটনীতিকদের একজন বলেন, অবশ্যই আমরা এখনো কোনো গেম চেঞ্জার নই। কমিশনের কাছ থেকে আরও উচ্চাভিলাষী প্রস্তাব আশা করা হচ্ছে। তবে এটি ঠিক কখন করা হবে তা স্পষ্ট নয়।
হয়তো এমনও হতে পারে, ইউক্রেন যুদ্ধের তীব্রতা শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে মিল আনতে পারে। গত মাসে, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ 'একটি শক্তিশালী, আরও সার্বভৌম ও ভূ-রাজনৈতিক ইউরোপীয় ইউনিয়ন' নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। প্যারিসে, শোলজের বিবৃতিটি মাখোঁর ২০১৭ সালের 'কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের' আহ্বানের বিলম্বিত উত্তর হিসেবে মনে করা হচ্ছে। মাখোঁ ইউরোপের প্রতিরক্ষা নীতিকে পুনরায় সক্রিয় করার আশা প্রকাশ করেন এবং 'একটি বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাজেট এবং মতবাদ' গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন।
কিন্তু কূটনৈতিক সৌজন্যের বাইরে শোলজ বা মাখোঁ কেউই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারেননি। ফ্রান্স এবং জার্মানি পোল্যান্ড, নর্ডিক ও বাল্টিক দেশগুলোর ইউরোপীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টার করেও ব্যর্থ হয়েছে।
বেশ কয়েকজন ফরাসী কর্মকর্তা বলেছেন, সামরিক অনুদানের সংখ্যাগুলে অকার্যকর ছিল, কারণ ফ্রান্স তার সমস্ত অনুদান প্রকাশ করেনি। ইনস্টিটিউট মন্টেইনের একজন পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিশেষজ্ঞ ফিলিপ মেজে-সেনসিয়ারের মতে, যদি তাই হয়, তবে এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত যা, ব্যাকফায়ার করেছে।
মেজে-সেনসিয়ার বলেন, আমরা কমিউনিকেশন গেম না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এর মানে ফ্রান্স আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে সপ্তম অবস্থানে আছে, তার মানে নরওয়ের সমান। কিন্তু আমরা নরওয়ের মতো একই লিগে খেলি না। এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই ইউরোপের প্রতিরক্ষার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা বৈধ নই।
তিনি মনে করেন, এই সংঘাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে মাখোঁর অতীতের প্রচেষ্টা, ফ্রান্সকে ইউক্রেনের উপর 'ভারসাম্য রক্ষাকারী' হিসেবে প্রচার করা, তার দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্যগুলোর ওপর সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। ক্রেমলিনের সঙ্গে তার যোগাযোগের পথ খোলা রাখার সিদ্ধান্ত অনেক অংশে ইইউকে উপহাস করার শামিল।
তিনি বলেন, ইউক্রেন নিয়ে আমাদের অবস্থানের কারণে ফ্রান্স বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, নর্ডিক দেশ, বাল্টিক রাজ্য এবং পূর্ব ইউরোপের আমাদের বন্ধুরা হতাশা হয়েছে। এমনকি তারা এই পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (সংহতির অভাবের) সঙ্গে তুলনা করেছে।
সূত্র: পলিটিকো, ডিপ্লোম্যাট
Comments