পরিযায়ী পাখি দিবসের তাৎপর্য

বড় খোঁপা ডুবুরী। ছবি: সংগৃহীত

মানব মনে সদাজাগ্রত হয়, পরিযায়ী পাখি মানেই তাকে শিকার করে দলবদ্ধভাবে ভোজনবিলাসে মত্ত হওয়া বা তাদের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা। মনগড়া এই ধারণা কি আদৌ সঠিক?

পরিযায়ী পাখিকে পরিব্রাজক বা যাযাবর পাখিও বলা হয়। পরিযায়ী পাখি বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি, যারা শীতের সময় বহু পথ পেরিয়ে আমাদের দেশে আসে এবং কিছুদিন অবস্থান করে।

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, পরিযায়ী প্রজাতি অর্থ ওই সব বন্যপ্রাণী, যারা এক বা একাধিক দেশের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় আসা-যাওয়া করে থাকে।

পৃথিবীতে প্রায় ১২ হাজার প্রজাতির পাখি আছে, তার এক-তৃতীয়াংশই পরিযায়ী পাখি। বাংলাদেশে ৭০০ এর অধিক প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে।

পাখিরা বিভিন্ন কারণেই পরিযায়ন করতে পারে। যেমন:

১. প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে পরিত্রাণ

২. পর্যাপ্ত খাদ্যের জন্য

৩. নিরাপদ প্রজননের জন্য

৪. বংশানুক্রমিক ধারাও হতে পারে

রাজশাহীর চরাঞ্চলে নীল-গলা ফিদ্দা (Bluethroat), সাইবেরীয় চুনিকন্ঠী (Siberian Rubythroat) পাখিরা আসে প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে মুক্তি পেতে। নীললেজ সুঁইচোরা (Blue tailed Bee Eater) পাখিরা ভারত উপমহাদেশ জুড়ে পরিযায়ন করে উপযুক্ত প্রজনন ভূমির খোঁজে। ইউরোপ থেকে লম্বা-লেজ তিশা বাজ (Long Legged Buzzard), মঙ্গোলিয়া থেকে স্টেপ ঈগল (Steppe Eagle) বাংলাদেশে আসে সহজ খাদ্য শিকারের জন্য।

বেশিরভাগ জলচর পাখি পরিযায়ন করে সমুদ্রের সীমারেখা ধরে। এদের মধ্যে কিছু পাখি বঙ্গোপসাগর থেকে নদীর উজানে উড়তে উড়তে বিভিন্ন জলাশয়ে আশ্রয় নেয়।

সারস, ঈগল, বাজসহ বেশ কিছু পরিযায়ী পাখি মধ্য ও উত্তর ইউরোপ থেকে সরাসরি ভারতীয় উপমহাদেশে পরিযায়ন করে। পরিযায়ী পাখিদের এক বিস্ময়কর প্রজাতি দাগী মাথা রাজহাঁস (Bar-headed Goose)। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, এরা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে উড়তে সক্ষম।

বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখিদের একটি বড় অংশ ঘাসবনের পাখি। এরা সাধারণত রাতের বেলা অন্ধকারে দলবেঁধে পরিযায়ন করে। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, এরা মূলত শিকারি পাখিদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে রাতের অন্ধকারে পরিযায়ন করে।

ডোরা মাথা রাজহাঁম। ছবি: সংগৃহীত

পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস। এদের মধ্যে বাংলাদেশে ১৭ প্রজাতির হাঁস পরিযায়ন করে। পরিযায়ী পাখিগুলো আমাদের দেশে বিল, ঝিল, হাওর, বাওড়, হ্রদ, নদ, নদী, নালা, সাগর ও জলাভূমিতে বাস করে থাকে।

আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের ধারণা, পরিযায়ী পাখি মূলত মাছ খেয়ে জীবনধারণ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরিযায়ী পাখিরা ভাসমান জলজ উদ্ভিদ, ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ ও পোকামাকড়, শামুক, ব্যাঙাচি, জলজগুল্ম, শ্যাওলা ইত্যাদি খেয়েও জীবনধারণ করে। কিছু পরিযায়ী পাখি ছোট মাছ খেয়ে থাকে।

পরিযায়ী পাখিরা শুধুমাত্র নিজেদের প্রশান্তির জন্যই আমাদের দেশে আসে না। আমাদের দেশে অতিথি হয়ে আসা এসব পাখি নানাভাবে আমাদের উপকারও করে চলেছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এ দেশের একশ্রেণীর মানুষ অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা ও আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য পরিযায়ী পাখি শিকার করে। অনেকে বাজারে বিক্রির জন্য বিষটোপ, বাটুল, জালের ফাঁদ ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের ফাঁদ ব্যবহার করে পরিযায়ী পাখি শিকার করে থাকে। শৌখিন শিকারিদের উদ্দেশ্যে মাংস খাওয়া এবং ক্ষমতা ও আভিজাত্যর বহিঃপ্রকাশ আর অন্যান্য শিকারিদের উদ্দেশ্যে বাজারজাত করে স্বল্প পরিশ্রমে বেশি আয় করা।

বাংলাদেশ সরকার পরিযায়ী পাখি/বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ প্রণয়ন করেছেন। সেই আইনের ধারা ৩৮ এর (১ ও ২) অনুযায়ী পরিযায়ী পাখিকে আঘাত করা, দখলে রাখা, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, মাংস ভক্ষণ, এয়ারগান দিয়ে শিকার, বিভিন্ন ধরণের ফাঁদ পেতে ধরা, প্রজননের সময় বিরক্ত, ডিম নষ্ট ও হত্যা করা ইত্যাদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ২ বছর কারাদণ্ড অথবা ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

আমরা গভীরভাবে কখনোই উপলব্ধি করি না, কিন্তু পরিযায়ী পাখি পরিবেশকে সুস্থ রাখার জন্য অনবদ্য অবদান রেখে চলছে প্রতিনিয়ত। পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড় নিধন করে। পরিযায়ী পাখি ফুল ও শস্যের পরাগায়ন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শীতের সময় ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির আগমনে নৈসর্গিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখির বিষ্ঠা জমিতে পড়ার ফলে জমির উর্বর শক্তি বৃদ্ধি পায়। জমিতে নাইট্রোজেনের আবির্ভাব ঘটিয়ে জমির উর্বর শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

কালো গির্দি। ছবি: সংগৃহীত

পরিযায়ী পাখি পানিতে সাঁতরানোর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখির বিষ্ঠায় মাছের খাবার তৈরি হয়, ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া, পরিযায়ী পাখির দৈহিক সৌন্দর্য, আকাশে উড়ার দৃশ্য, বৈচিত্র্যময় জীবনাচরণ মানুষকে বিনোদন দেয়।

বিশ্বজুড়ে পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে, পরিযায়ী পাখির গুরুত্ব সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং প্রকৃতিতে পাখির অসামান্য অবদানের কথা বিবেচনা করে বিশ্ব বিবেকরা ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম শনিবার আড়ম্বরপূর্ণভাবে পরিযায়ী পাখি দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেন।

এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য 'Dim the Lights for Birds at Night', বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় 'ম্লান করলে রাতের আলো পাখিরা থাকবে আরও ভালো'।

দিবসটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ছড়িয়ে যাক সবার মাঝে। তাহলেই বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস উদযাপন সার্থক হবে। পরিযায়ী পাখিদের আমরা মেহমানের দৃষ্টিতে দেখি, তাদের মুক্ত চলাচলে সহায়তা করি এবং স্বীয় নাগরিক দায়িত্ব পালন করি। পরিযায়ী পাখিতে সমৃদ্ধ হোক আমাদের এই ছোট্ট ভূখণ্ড।

মো. জাহাঙ্গীর কবির, বন্যপ্রাণী পরিদর্শক, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, রাজশাহী

Comments

The Daily Star  | English

Moody's downgrades Bangladesh's ratings to B2, changes outlook to negative

“The downgrade reflects heightened political risks and lower growth, which increases government liquidity risks, external vulnerabilities and banking sector risks, following the recent political and social unrest that led to a change in government,” said Moody’s.

2h ago