আ. লীগ নেতার নেতৃত্বে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-দোকান ভাঙচুর-লুটপাটের অভিযোগ

হামলাকারীরা ২টি বাড়ি ও ৬টি দোকান ভাঙচুর করে এবং লুটপাটের জিনিস ট্রাকবোঝাই করে নিয়ে যায়। ছবি: স্টার

নাটোরের সিংড়া উপজেলায় ইটালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আরিফের নেতৃত্বে পাকুরিয়া গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি এবং দোকানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গতকাল সোমবার বিকেলের দিকে এ ঘটনা ঘটে। হামলাকারীরা সেসময় ২টি বাড়ি ও ৬টি দোকান ভাঙচুর করে এবং লুটপাটের জিনিস ট্রাকবোঝাই করে নিয়ে যায় বলে জানা গেছে।

এ ঘটনাকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ও ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে হিন্দু নির্যাতনের সঙ্গে তুলনা করে বিচার চেয়েছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের স্ত্রী এবং সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আরিফা জেসমিন কনিকা।

আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে আরিফা জেসমিন কনিকা লিখেছেন, 'গতকাল সোমবার বিকাল ৪টার পর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আরিফ চেয়ারম্যান নিজে উপস্থিত থেকে এ তাণ্ডব চালায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই আরিফ চেয়ারম্যান নৌকার বিরুদ্ধে ৭টি ইউনিয়নে ঘোড়া মার্কার বিদ্রোহী প্রার্থী দিয়ে নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করেছে। ঘটনার সূত্রপাত সেখান থেকেই। প্রতিটি ইউনিয়নেই তারা একইভাবে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ওপর দমন, নির্যাতন, নিপীড়ন চালাচ্ছে। দল এবং প্রশাসন এই সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে জিম্মি।'

ছবি: আরিফা জেসমিন কনিকার ফেসবুক থেকে নেওয়া

নির্যাতিতদের বরাত দিয়ে কনিকা আরও লিখেন, '৯৯৯ নম্বরে ফোন করে আধা ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করেছে। কিন্তু সিংড়া থানা পুলিশ ফোন রিসিভ করেনি। লুটপাটের পরে সন্ধ্যায় পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ কথা বলারও সাহস পাচ্ছে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং প্রশাসনের কাছে আমি এই সন্ত্রাসীদের বিচার চাই।'

এ বিষয়ে আরিফা জেসমিন কনিকা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, নির্যাতিতদের কাছ থেকে ঘটনাটি জানতে পেরে তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন।

বিষয়টিকে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে আমি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছি। আমরা চাই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা না ঘটুক। কেউ যেন কারও কাছে জিম্মি হয়ে না থাকে।'

এ ঘটনায় আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হামলার ঘটনা জানার পর প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। তবে বিষয়টিকে কেউ কেউ ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা করছে।'

এই হামলার বিচার চেয়ে ফেসবুকে স্ত্রীর পোস্ট দেওয়ার বিষয়ে পলক বলেন, 'ফেসবুক পোস্ট যিনি দিয়েছেন, সেটা তার নিজস্ব বিষয়। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না।'

ছবি: স্টার

ইটালী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জাহাঙ্গীর আলম ডেইলি স্টারকে জানান, গত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলামের সমর্থিত প্রার্থী আলিফ হোসেনকে হারিয়ে তিনি মেম্বার নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই তাকে পদত্যাগের হুমকি দিয়ে আসছিলেন চেয়ারম্যান। কিন্তু জাহাঙ্গীর পদত্যাগ করেননি।

'এর জেরেই গতকাল বিকেল ৩টার দিকে চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম ও আলিফ হোসেনের নেতৃত্বে ২০০-২৫০ জনের একটি দল লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমার সমর্থকদের বাড়ি ও দোকানে হামলা চালায়', বলেন তিনি।

জাহাঙ্গীর মেম্বার বলেন, 'হামলার সময় লুটপাটের জিনিসপত্র মিনিট্রাকে করে তুলে নিয়ে গেছেন চেয়ারম্যান আরিফুল ও তার সমর্থকরা।'

এর আগে, পাকুরিয়া গ্রামে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিয়োগ নিয়েও আলিফের সঙ্গে তার বাগবিতণ্ডা হয় বলে জানান জাহাঙ্গীর মেম্বার।

তিনি বলেন, 'স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মুত্তালাল চক্রবর্তী এবং রতন কুণ্ডু আমার সমর্থক হওয়ায় তাদের বাড়ি ও দোকান গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।'

এসময় বাজারের পাশে আইনজীবী মানিকলাল চক্রবর্তীর বাড়ি ও অফিস কক্ষেও ভাঙচুর চালানো হয়। এর প্রতিবাদ করলে মানিকলালের ছোট ভাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুক্তালাল চক্রবর্তীকেও মারধর করা হয়। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে বলে জানান জাহাঙ্গীর মেম্বার।

এ ঘটনায় আজ বিকেলে সিংড়া থানায় একটি মামলা করেছেন মুক্তালাল চক্রবর্তী। মামলায় চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম, আলিফ হোসেনসহ ৭ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত ২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এ ছাড়া, হামলার ঘটনায় নিজে বাদী হয়ে আরও একটি মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর মেম্বার।

ছবি: স্টার

তবে হামলায় নেতৃত্বদানের কথা অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম।

তিনি ডেইলি স্টারকে জানান, 'হামলার সময় তো দূরের কথা, তিনি গত ১০ দিনেও পাকুরিয়া এলাকায় যাননি। তবে ভুক্তভোগী ও আরিফা জেসমিন কনিকা কেন তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুলেছেন, তা তার বোধগম্য নয়।

নাটোরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাইফুর রহমান এবং জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদসহ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা আজ বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

পুলিশ সুপার মো. সাইফুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইউপি নির্বাচন নিয়ে মেম্বার প্রার্থী আলিফ হোসেন এবং অপর প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের বিরোধ চলে আসছিল। পরে মসজিদের মোয়াজ্জেম নিয়োগকে কেন্দ্র করে আলিফ হোসেন ও তার সমর্থকরা বেশকিছু বাড়িঘর এবং দোকানপাট ভাঙচুর করেছেন। সেখানে দুজন হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যের বাড়িও ছিল। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তদন্তে জানা যাবে কারা কতটুকু জড়িত ছিল।'

সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জান্নাতুল ফেরদৌস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আলিফ হোসেন ও জাহাঙ্গীর মেম্বারের মধ্যে বিরোধ থেকেই এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। মুক্তালাল চক্রবর্তীর মার্কেটে জাহাঙ্গীর ভাড়া থাকতেন, সেই দোকানসহ মুক্তালালের ঘরও ভেঙেছেন হামলাকারীরা। পরাজিত মেম্বার প্রার্থী আলিফ ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুলের সমর্থক এবং জাহাঙ্গীর মেম্বার উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলামের সমর্থক। এ ঘটনায় যদি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলামের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় তবে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh transition from autocracy to democracy

Transitioning from autocracy to democracy: The four challenges for Bangladesh

The challenges are not exclusively of the interim government's but of the entire political class.

5h ago